দেশে প্রথমবার রাজকাঁকড়া নিয়ে গবেষণা, রক্তের গ্যালন ৫০ লাখ টাকা

বঙ্গোপসাগরের রাজকাঁকড়া এবং ওয়েস্টার ঝিনুক নিয়ে সুনীল অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যে কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সামুদ্রিক এই প্রাণী দুটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। গবেষণায় সফলতা এলে চিকিৎসাশাস্ত্রসহ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে বলে আশা তাদের। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে রাজকাঁকড়ার রক্তের গ্যালন ( ৪.৫৪৬ লিটার) ৫০ লাখ টাকা।

বঙ্গোপসাগরের জীবন্ত জীবাশ্ম নামে পরিচিত নীল রক্তের সামুদ্রিক প্রাণী রাজকাঁকড়া এবং ওয়েস্টার বা ঝিনুক। রক্তের ঔষধি গুণের কারণে রাজকাঁকড়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বে ছয়-সাত দশক আগে গবেষণা শুরু হলেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গবেষণা শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে ওয়েস্টার বা ঝিনুকের চাষ, সাগর শশা ও জেলিফিশ নিয়েও গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

গবেষকরা বলছেন, রাজকাঁকড়ার নীল রক্ত মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ড্রাস্টিতে অনেক মূল্যবান। ঔষধি গুণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ব্যাপক। এ কারণে কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এ বছর গবেষণার কাজ শুরু করেছে। শুধু রাজকাঁকড়া নয়; বঙ্গোপসাগরের আরও একটি মূল্যবান সামুদ্রিক প্রাণী নিয়েও গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এটি হলো ওয়েস্টার বা ঝিনুক। ওয়েস্টারের চাষ নিয়ে ইতোমধ্যে ব্রিডিংয়ের কাজ করার কথা জানিয়েছেন কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকিয়া হাসান। 

কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলের জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে ‘রাজকাঁকড়া’ দেখা যেতো

জাকিয়া হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সমুদ্রের সুনীল অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে নতুন নতুন গবেষণা চলছে। বিশেষ করে রাজকাঁকড়া এবং ওয়েস্টারের পাশাপাশি সাগর শশা, জেলিফিশসহ আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবান সমুদ্রসম্পদ নিয়ে কাজ চলছে। আমরা অনেকটা সফলতার দ্বারপ্রান্তে। কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক মাছ চাষ, মাছের পোনা ও খাদ্য উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে। এসব পোনা ও খাদ্য বিভিন্ন মাছের হ্যাচারিতে ব্যবহার হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজেও আসে।’

সমুদ্র গবেষক ও সাংবাদিক আহমদ গিয়াস বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের একমাত্র জীবন্ত জীবাশ্ম হলো হর্সশো ক্র্যাব বা রাজকাঁকড়া। যেটি স্থানীয়ভাবে ‘দিও কিঁয়ারা’ নামে পরিচিত। প্রকৃতির ভাঙাগড়া ও দুর্যোগের মধ্যেও বছরের পর বছর অবিকৃতভাবে টিকে আছে রাজকাঁকড়া। এই প্রাণীর নীল রক্ত ঔষধি গুণসম্পন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭০ বছর আগে এই প্রাণীর ঔষধি গুণ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কর্তৃপক্ষ ঔষধি কাজে এই প্রাণীর রক্ত ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।’

কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে সুনীল অর্থনীতিকে টেকসই প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও উন্নত করতে কাজ করছে সরকার। দিন দিন দক্ষ জনবল বাড়ছে। বিদেশ থেকে যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে দেশে আসছেন, তারাও সমুদ্র গবেষণায় আগ্রহী হচ্ছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট বিষয় বেছে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এতে জনবল ঘাটতি কমে আসছে। বাড়ছে সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে গবেষণা। এরই ধারাবাহিকতায় রাজকাঁকড়া এবং ওয়েস্টার বা ঝিনুক নিয়ে গবেষণা চলছে।’

কক্সবাজারে চলছে রাজকাঁকড়া নিয়ে গবেষণা

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, ঔষধি গুণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে রাজকাঁকড়ার এক গ্যালন রক্তের দাম ৬০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। রাজকাঁকড়ার নীল রক্ত মানুষের চিকিৎসায় এনেছে জাদুকরি পরিবর্তন। মানুষের শরীরের দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ এবং মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে রাজকাঁকড়ার নীল রক্ত অনেক কার্যকর। 

এ ছাড়া রাজকাঁকড়ার শরীরের পেছনে থাকা লেজ দিয়ে তৈরি করা হয় ক্যানসারের ওষুধ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে একেকটি রাজকাঁকড়ার দাম অনেক বেশি। একটি নারী রাজকাঁকড়া বছরে ৬০ থেকে এক লাখ ২০ হাজার ডিম দেয়। এরমধ্যে কয়েক হাজার বেঁচে থাকে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। তবে দুই যুগ আগেও কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলের জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে রাজকাঁকড়া দেখা যেতো। কিন্তু বিস্তীর্ণ উপকূল থেকে এখন রাজকাঁকড়া প্রায় হারিয়ে গেছে। তবে গভীর সমুদ্রে রয়েছে প্রচুর রাজকাঁকড়া।