ইউক্রেনে বাংলাদেশি জাহাজে হামলা

চট্টগ্রাম বিএসসি ভবনে উদ্বিগ্ন স্বজনদের ভিড়

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে রকেট হামলায় খবর শুনে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) কার্যালয়ে ছুটে এসেছেন নাবিকদের স্বজনরা। জাহাজে হামলায় একজনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে উদ্বিগ্ন তারা। বেঁচে থাকা ২৮ জনের ভাগ্যে কি আছে, তারা সুস্থভাবে বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা, এসব নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন স্বজনরা।

বৃহস্পতিবার (০৩ মার্চ) সকাল থেকে বিএসসি কার্যালয়ে আসতে থাকেন নাবিকদের স্বজনরা। ইতোমধ্যে অনেকের পরিবার এসেছেন। জাহাজে আটকে পড়াদের খোঁজখবর জানতে চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর এলাকায় বিএসসি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার কথা বলেছেন স্বজনরা। জানতে চেয়েছেন নাবিকদের সর্বশেষ অবস্থার কথা।

জাহাজে কর্মরত নাবিক মোহাম্মদ হানিফের খোঁজে সকালে এসেছেন তার সন্তান মো. কায়সার হামিদ। তিনি বলেন, ‘জাহাজে হামলার আগে বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ওই সময় জানিয়েছেন ভালো আছেন। কিন্তু হামলার পর থেকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এজন্য বাবার খোঁজে এখানে ছুটে এসেছি।’

দুপুরে বিএসসি কার্যালয়ে দেখা হয় মো. ওবাইদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ছেলে মো. মাসুম বিল্লাহ আছে ওই জাহাজে। সে কেমন আছে, যোগাযোগ করতে পারছি না। তার কোনও খোঁজখবর পাচ্ছি না। আমিসহ পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি। এজন্য সন্তানের খোঁজে বিএসসি কার্যালয়ে এসেছি। 

আরও পড়ুন: ইউক্রেনে জাহাজে থাকা ২৮ বাংলাদেশির পরিচয় মিলেছে

ফেনীর সোনাগাজীর বাসিন্দা ওবায়দুল হক পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রামের কাটগড় এলাকায়। জাহাজ থেকে ছেলের বার্তা পেয়ে ছুটে এসেছেন তিনি। ওবায়দুল হক বলেন, ‘জাহাজে হামলার পর থেকেই আতঙ্কে আছি। আমার দাবি একটাই, সন্তানকে ফেরত চাই।’

ওবায়দুল হকের মতো আটকা পড়াদের কারও ভাই, কারও বাবা বিএসসি কার্যালয়ে এসেছেন স্বজনের খোঁজে। বিএসসি কর্মকর্তারা জানান, জাহাজে আটকে থাকা ২৮ জনের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছি। সাধ্যমতো তাদের স্বজনদের আমরা অবহিত করছি।

জাহাজে থাকা ২৮ নাবিকের মধ্যে দুই জনের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। তারা হলেন বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ওমর ফারুক। তিনি সন্দ্বীপ উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। অপরজন জাহাজের ক্রু হোসাইন মোহাম্মদ রাকিব। তার বাড়ি একই উপজেলার গাছুয়া ইউনিয়নে।

বিকালে কথা হয় রাকিবের বাবা মো. আলী খোকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত ১৯ জানুয়ারি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে ক্রু হিসেবে আমার ছেলের চাকরি হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে শ্রীলঙ্কা হয়ে সিঙ্গাপুর বন্দরে নোঙর করা ওই জাহাজে ওঠে। এরপর নিয়মিত কথা হয়েছে। সর্বশেষ কথা হয় মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এরপর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফেসবুক আর গণমাধ্যমের খবর ছাড়া তার খোঁজখবর পাচ্ছি না।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ওই জাহাজে বুধবার রাতে রকেট হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে একজন মারা গেছেন। আমার ছেলে রাকিবসহ বাকিরা কেমন আছে, তা বুঝতে পারছি না। আল্লাহ যেন আমার ছেলেকে হেফাজতে রাখেন, নিরাপদে রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভব রাকিবসহ জাহাজের সবাইকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন।

আরও পড়ুন: ইউক্রেন থেকে সকালেও ফোন করেছিলেন আরিফ, বলেছিলেন স্বপ্নের কথা

রাকিবের বড় ভাই আরাফাত হোসেন হৃদয় বলেন, ‘রাকিব কেমন আছে? ঠিক মতো বাড়ি ফিরতে পারবে তো? এ নিয়ে আমরা পুরো পরিবার দুশ্চিন্তাই আছি। বিএসসির অনেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন। তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।’

এর আগে অলভিয়া বন্দরে নোঙর করা বিএসসির জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধিতে’ রকেট হামলায় থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। জাহাজের বাকি ২৮ জন নাবিক ও ক্রু অক্ষত আছেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) নির্বাহী পরিচালক পীযূষ দত্ত।

তিনি বলেন, ‌‘ইতোমধ্যে জাহাজে থাকা নাবিক ও ক্রুদের উপকূলে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ ও নিরাপদে আছেন।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী বলেন, ‘আটকে থাকা ২৮ নাবিককে আমরা সেফ জোনে নিতে পেরেছি। তারা নিরাপদে আছেন। থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের মরদেহ বহন করছেন তারা। নাবিকরা নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করছেন।’

আরও পড়ুন: বিয়ের পিঁড়িতে বসা হলো না আরিফের

এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে আটকে পড়া জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধির নাবিকরা নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করছেন। শাহরিয়ার আলম এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ২৮ নাবিককে আমরা সেফ জোনে নিয়েছি। তারা নিরাপদে আছেন। খুব দ্রুত তাদের পোল্যান্ডের ওয়ারশোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে পারবো।’

বিএসসি কার্যালয় সূত্র জানায়, জাহাজটি ইউক্রেনের বন্দর থেকে পণ্য ভর্তি করে ইতালির বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় ওই বন্দর থেকে পণ্য লোডিং কাজ বাতিল করা হয়। এ কারণে জাহাজটি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে নোঙর করে রাখা হয়। জাহাজটিতে অন্তত ২৫ দিনের রসদ মজুত আছে। তুরস্কের এরেগলি বন্দর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি খালি জাহাজটি অলভিয়া বন্দরের উদ্দেশ্য ছেড়ে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে পৌঁছে। এরই মধ্যে ঘটে দুর্ঘটনা।