উৎসবপ্রিয় পাহাড়িরা সারা বছর মেতে থাকেন নানান অনুষ্ঠানে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসব, যা বৈসাবি নামে পরিচিত। বাংলা বর্ষের শেষ দিন (২৯ চৈত্র) চাকমারা ‘ফুল বিজু’, ত্রিপুরারা ‘হাঁড়িবসু’ আর মারমা সম্প্রদায়ে সূচিকাজ নামে পালন করে এ উৎসব যা ফুল বিজু নামে সর্বাধিক পরিচিত। কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে রাঙামাটিতে শুরু হয়েছে ‘বৈসাবি’র মূল আয়োজন। পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসব ১৬ এপ্রিল মারমা সম্প্রদায়ের জলকেলি’র মাধ্যমে শেষ হবে।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকালে রাঙামাটি শহরের বিভিন্নস্থানে কাপ্তাই হ্রদের জলে নানান রঙের ফুল ভাসিয়ে উদযাপিত হয় ফুল বিজু। এসময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন উপস্থিত তরুণ-তরুণীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এই সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি পল্লী। বাংলা বর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষে চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও অহমিয়ারা বিহু নামে পালন করছে এই উৎসব। উৎসবের প্রথম দিনে ফুল আর নিমপাতা দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছে। বুধবার বিজু’র মূল আয়োজন। এদিন পাহাড়িদের ঘরে ঘরে চলবে পাঁচন আতিথেয়তা।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বয়সী পাহাড়িরা ফুল নিয়ে আসতে শুরু করে বিভিন্ন ঘাটে। খুব ভোরে মা গঙ্গার উদ্দেশে নদীতে পবিত্র ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। উৎসবে নারীরা বাহারি রঙের পিনোন হাদি পরে আর ছেলেরা ধুতি, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া পরে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল ভাসান। পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে পুরনো বছরের সব গ্লানি মুছে যাবে, নতুন বছর বয়ে আনবে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
রাজবাড়ীঘাটে ফুল ভাসিয়েছেন অমর কুমার চাকমা। তিনি জানান, এটি পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ঐহিত্যবাহী সামাজিক উৎসব। করোনার কারণে গত দুই বছর উৎসবটি সেভাবে পালিত হয়নি। বিশ্ব যেন করোনা থেকে মুক্তি পায়, সেই প্রার্থনা করা হয় মা গঙ্গা দেবীর কাছে। পৃথিবী যেন ভালো হয়ে উঠে এমনাটাই প্রত্যাশা।
সীমা চাকমা বলেন, সকালে ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজিয়ে এখন ফুল ভাসাতে এসেছি। ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ-বেদনাকে ভাসিয়ে দিলাম। নতুন বছর যেন সুন্দরভাবে কাটে এটাই প্রত্যাশা। করোনা থেকে দ্রুত বিশ্ব মুক্ত হোক। আমরা সবাই আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি, এটাই কামনা করি।
বৈসাবি উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, পাহাড়ে বসবাসকারী পাহাড়ি-বাঙালি মিলে সুখে-শান্তিতে যেন বসবাস করতে পারি, ফুল বিজুর মাধ্যমে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। একইসঙ্গে আগামীর দিনগুলো যেন আনন্দে কাটে সবার।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে এই আনন্দ উদযাপন সম্ভব হয়নি। এবার করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকায়, আবারও সবাই একসঙ্গে মিলিত হতে পেরেছি।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা বর্ষকে বিদায় ও বরণের এই অনুষ্ঠান তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। এই উৎসব চাকমা জনগোষ্ঠী বিজু নামে, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মানুষ সাংগ্রাই, মারমা জনগোষ্ঠী মানুষ বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বিষু, কোনও কোনও জনগোষ্ঠী বিহু নামে পালন করে থাকে।
বৈসুকের ‘বৈ’ সাংগ্রাইয়ের ‘সা’ ও বিজু, বিষু ও বিহুর ‘বি’ নিয়ে উৎসবটিকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে পালন করা হয়। পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে পাহাড়ের সকল জনগোষ্ঠীকে সম্মিলিতভাবে উৎসবে এক করতে এই সংক্ষেপে নামটি প্রচলন করা হয়েছে।