‘কিসের গুডস হিল, আজ থেকে এটা রাজাকার হিল’

মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর চট্টগ্রাম নগরের বাসভবন ‘গুডস হিলের’ সামনে এখন ঝুলছে ‘রাজাকার হিলের’ সাইনবোর্ড। শনিবার (২৯ অক্টোবর) বিকালে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবেশ পথেই ‘রাজাকার হিল’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে। এই সাইনবোর্ডের ওপরে লেখা আছে, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন কেন্দ্র’। বাড়ির গেটে দেওয়া হয়েছে প্রতীকী তালা। দেয়ালে এঁকে দেওয়া হয়েছে নিষিদ্ধ ক্রস চিহ্ন। লেখা হয়েছে, ‘রাজাকারের বাড়ি’সহ নানা কথা।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা শাখা এই সাইনবোর্ডটি সকালে লাগিয়েছে। এছাড়াও গুডস হিলের প্রবেশ পথে রং দিয়ে দেওয়ালে লেখা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন কেন্দ্র রাজাকারের বাড়ি।’

পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি হিসেবে শনিবার (২৯ অক্টোবর) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সাকা চৌধুরীর বাড়িটির সামনে অবস্থান নেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ। কয়েকঘণ্টায় তারা পুরো বাড়িটির বাইরের অংশের চিত্র পাল্টে দেন। এ উপলক্ষে গুডস হিলে প্রবেশ পথ অবরুদ্ধ করে আয়োজন করা হয় সমাবেশের। এর আগে, বিভিন্ন থানা, উপজেলা ও ওয়ার্ড থেকে মিছিল নিয়ে বাড়িটি ঘেরাও কর্মসূচিতে আসেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ও ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

সমাবেশ মঞ্চের একপাশে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাকা চৌধুরীর প্রতিকৃতি রেখে সেখানে ধিক্কার জানিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য লেখা হয়। উপস্থিত লোকজন বিভিন্নভাবে স্লোগানে মুখর করে রাখেন গুডস হিল থেকে গণি বেকারি মোড় পর্যন্ত। সমাবেশ শেষ হওয়ার পর গেটে প্রতীকী তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

কেন এই কর্মসূচি?

সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তার এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে ঝড় ওঠে। কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা হুম্মাম কাদের চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, ‘আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি বড় নেতা হিসেবে নয়। আজকে এসেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হিসেবে। আপনারা সবাই সঙ্গে থাকলে আমাদের পরাজিত করার শক্তি কারও নেই। এই আওয়ামী লীগ সরকারকে বলে দিতে চাই, ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর একা বাড়ি যেতে পারবেন না। প্রতিটি শহীদের পরিবার থেকে ক্ষমা চেয়ে যেতে বাধ্য করা হবে। যাওয়ার আগে আমার বাবার স্লোগান আপনাদের বলে যেতে চাই।’

saka2

এরপর হুম্মাম কাদের চৌধুরী তিন বার ‘নারায়ে তাকবির’ বললে প্রতিবারই ‘আল্লাহ আকবর’ বলে পাল্টা সাড়া দেন মাঠে উপস্থিত বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরপর বলেন, ‘আমরা আবার যখন এই পলোগ্রাউন্ড মাঠে আসবো, তখন সরকার গঠন করেই আসবো।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চট্টগ্রাম মহানগর শাখার আহ্বায়ক সাহেদ মুরাদ সাকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। অথচ তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী পিতাকে জনসভায় দেওয়া বক্তব্যে শহীদ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে আমরা ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছি।’

শনিবারের ঘেরাও কর্মসূচি থেকে পাঁচ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সরওয়ার আলাম চৌধুরী মনি এসব দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো- যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের রাজনীতি ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা, মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্যাতনের জন্য রাজাকার-আলবদর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গড়ে তোলা সব ‘টর্চার ক্যাম্পকে’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সব যুদ্ধাপরাধীর তালিকা করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং হুম্মামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা।

ঘেরাও কর্মসূচিতে সাকা চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অন্যতম সাক্ষী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার বলেন, ‘একাত্তর সালে কুখ্যাত রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরী আর তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়িতে যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, সেখানকার মানুষ যখন নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, তখন আমি এই শহরে চন্দনপুরায় গলির মুখে সালাউদ্দিনের গাড়িতে আক্রমণ করেছিলাম। আমাদের কাছে খবর ছিল, সালাহউদ্দিন কাদের ড্রাইভিং সিটে থাকবে। সে জন্য ড্রাইভিং সিট লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছিলাম। কিন্তু সে ওই সিটে ছিল না, তবে আহত হয়েছিল। গাড়িচালক মারা গিয়েছিল। আমি এখানে কোনও দলের নেতা হিসেবে বক্তব্য দিতে আসিনি, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন যেমন সালাউদ্দিন কাদেরকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারছিল না, আমিসহ কয়েকজন এই শহরে আক্রমণ করেছিলাম, তেমনিভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর কেউ সাক্ষ্য দিচ্ছিল না। আমি গিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছি। নিজের জীবনের নিরাপত্তা, পরিবারের নিরাপত্তা তুচ্ছ করে আমি সাক্ষ্য দিয়েছিলাম।’

সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের সন্তানদের রাজনীতিতে দেখতে চাই না। রাজাকারের সন্তানদের নির্বাচনে দেখতে চাই না। রাজাকারের বাড়িঘর, সম্পত্তি অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা হোক। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে সরকারকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। আগেভাগে বলে দিচ্ছি, সরকার যদি আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবো।’

রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘কিসের গুডস হিল, আজ থেকে এটা রাজাকার হিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা এটাকে রাজাকার বাড়ি লিখে দিয়েছে। হুম্মাম কাদের, কুলাঙ্গারের ঘরে কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েছে।’

সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন- চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নইম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ কে এম এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর মামলার অন্যতম সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মো. মশিউর রহমান চৌধুরী।

সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল হক চৌধুরী সৈয়দ, আকবর শাহ থানার ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরউদ্দিন, চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শাহবুদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য জামশেদুল আলম চৌধুরী, চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাহেরুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়েছিল।