X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১
দুই বছরেও শেষ হয়নি নির্মাণকাজ

রায়পুরে ‘বীর নিবাস’ নির্মাণে অনিয়ম, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ

তাবারক হোসেন আজাদ, রায়পুর (লক্ষ্মীপুর)
১০ মার্চ ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৪, ১১:১৬

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন ‘বীর নিবাস’ নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একেক গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর নির্মাণে একেক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুই বছর আগে ঘরের নির্মাণকাজ শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। উল্টো ঘর নির্মাণে সিমেন্ট, বালু ও মাটি দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার। কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধার পরিবার আতঙ্ক নিয়ে বাধ্য হয়ে রান্নাঘরেই রাতযাপন করছে।

গত ৭ ও ৮ মার্চ উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির হাজিমারা আশ্রয়ণকেন্দ্রের পাশে, উত্তর চরআবাবিল ইউপিতে তিনটি, হায়দরগঞ্জ বাজারে পাশে, রায়পুর ইউপিতে দুটি এবং বামনী ইউপির কাপিলাতুলি বাজার এলাকার পাশে ‘বীর নিবাস’ ঘুরে সত্যতা পাওয়া যায়।

এ অনিয়মের বিষয়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হারিস মাহমুদের স্ত্রী শাহারা পারভীন ও ২ নম্বর ওয়ার্ড দেবীপুর গ্রামের গ্রাম পুলিশ লিটনসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ করবেন বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে আবাসন (বীর নিবাস) নির্মাণের জন্য ৪ কোটি ৩৭ লাখ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয় ১৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।

রায়পুর ইউপির দেবিপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সফিউল্লাহর ভবন

দরপত্র আহ্বান করা হলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচিত হন পাঁচ জন। তারা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন, বিআরডিবি চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান খান, ব্যবসায়ী মো. ডালিম, আলমগীর হোসেন ও চরমোহনা ইউপি সদস্য মো. আরজু।

উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চরকাছিয়া গ্রামের হাজিমারা আশ্রয়ণকেন্দ্রে একটি ‘বীর নিবাস’ নির্মাণ করা হচ্ছে। কার্যাদেশ পেয়ে ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করেন ওই ঠিকাদার।

কিন্তু ঠিকাদার নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এক নম্বরের পরিবর্তে দুই নম্বর ইট ব্যবহার এবং পরিমাণমতো সিমেন্টও ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন খোদ উপকারভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী, এক গ্রাম পুলিশ ও এক ইউপি সদস্য।

উত্তর চরআবাবিল ইউপির উদমারা গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারিস মাহমুদের ভবন

বামনী ইউপির কাপিলাতুলি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তসলিম উদ্দিন মাস্টার (৭০) বলেন, ‘আমার ঘরটি দুই বছর ধরে করছে। গত এক মাস কাজ বন্ধ। পাশের গ্রামের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকের ঘরের অবস্থাও একই রকম। ঠিকাদারকে খুঁজে পাচ্ছি না, ফোনও ধরছে না।’

গ্রামবাসীর অভিযোগ, যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা এসব বিষয়ে কম বোঝেন, তাদের ঘরগুলো নির্মাণে আরও বেশি অনিয়ম হচ্ছে। ঠিকাদার নিজে কাজ না করে সাব-ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাচ্ছেন।

দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চরকাছিয়া গ্রামের (হাজিমারা আশ্রয়ণকেন্দ্রে বসবাসকারী) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন মোল্লার ছেলে দিনমজুর খোকন মোল্লা বলেন, ‘আমি দিনমজুরের কাজ করি। ঠিকাদার তার লোকদের দিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ করছেন। আমি ঘরটি ভালো হওয়ার জন্য সিমেন্ট ও বালু দিয়েছি। ১০ দিন আগে প্রকৌশলী এসেছিলেন। আর কেউ আসেননি। তদারকি হলে কাজের মান ভালো হয়।’

দক্ষিণ চরবংশী ইউপির চরকানিয়া গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হোসেন মোল্লার ভবন

উত্তর চরআবাবিল ইউপির (হায়দরগঞ্জ বাজারের পাশে বসবাসকারী) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হারিস মাহমুদের স্ত্রী শাহারা পারভীন বলেন, ‘ছয় মাস আগে ঘরের অর্ধেক কাজ করে ফেলে রেখেছে ঠিকাদার। ঘরের কোনও কাগজপত্র নেই। ঠিকাদারের খোঁজখবর নেই। এক নাতিনকে নিয়ে ভাঙা রান্না করে আতঙ্কে রাতযাপন করতে হচ্ছে। স্বামীর করবটিও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ইউএনও ও পিআইও অফিসে কয়েকবার গেলেও কেউ গুরুত্ব দেয়নি। আমি অসুস্থ, পঙ্গু মানুষ।’

রায়পুর দেবীপুর গ্রামের শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সফি উল্লাহর ছেলে গ্রাম পুলিশ লিটন অভিযোগ করে বলেন, ‘দুই নম্বর ইট দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, এটা জাতির জন্য কলঙ্কের। তা ছাড়া সিমেন্টের ভাগ কম ও বালু বেশি দেওয়া হচ্ছে। যেকোনও সময় ছাদ ধসে পড়বে। আমি আরও এক লাখ টাকা খরচ করেছি। স্কুল ও কলেজপড়ুয়া ছেলে-মেয়েসহ স্ত্রীর সঙ্গে রাতে রান্নাঘরে বাধ্য হয়ে এক খাটে ঘুমাতে হচ্ছে। বৃষ্টির সময় অনেক কষ্ট পেয়েছি। টয়লেট করতে পারছি না। গত দুই বছর ধরে ঠিকাদার বিআরডিবির চেয়ারম্যান শফিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে কাজই শেষ হচ্ছে না। ইউপি চেয়ারম্যান এমপির শ্যালক সুমন চৌধুরীর কথাও শোনে না ঠিকাদাররা। বিষয়টি আমি মুক্তিযোদ্ধাদের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানাবো।’

সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার শফিকুর রহমান খান জানান, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর নির্মাণকাজ কোনও ঠিকাদার করতে চায় না। বর্তমান ঘরের বাজেটের সঙ্গে মালামালের দাম অনেক তফাত। আমার অধীনে ছয়টি ঘরই প্রায় সম্পূর্ণ। কিছু কাজ বাকি থাকায় শেষ হতে দেরি হচ্ছে।’

রায়পুর ইউপির দেবিপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আয়াত উল্লাহ খানের ভবন

ঠিকাদার জাহাঙ্গীর হোসেন ও আরজু মেম্বার বলেন, ‘কাজে কোনও অনিয়ম হচ্ছে না। নিম্নমানের ইট, বালু, রড, সিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ আমাদের যথাসময়ে টাকা দিচ্ছে না। কাজ অর্ধেক করলে একভাগের টাকা দেয়। সহসাই কাজ শেষ করে প্রকৌশলীকে বুঝিয়ে দেবো।’

ঠিকাদার আলমগীর হোসেন ও ঠিকাদার ডালিম বিদেশে থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

রায়পুর উপজেলার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জিএম মহসিন রেজা বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরেছি। দ্রুত কাজ শেষ করতে ইউএনও ঠিকাদারদের তাগিদ দিয়েছে।’

উত্তর চরআবাবিল ইউপির উদমারা গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারিস মাহমুদের ভবনের সামনে তার অসুস্থ স্ত্রী

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, ‘বীর নিবাস নির্মাণে একটি ঘরেও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ পেলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না। কোনও ঘরে এ ধরনের অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইটসহ নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী গ্রহণযোগ্য হবে না।’

রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমা বিনতে আমিন বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা ঘরগুলো দ্রুত শেষ করার জন্য ঠিকাদারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরেছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ছবি: প্রতিবেদক

/আরআইজে/এনএআর/
সম্পর্কিত
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
‘ভুয়া ৮ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে’
সর্বশেষ খবর
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে