পুরনো বই বিক্রিতে ভাটা, ভালো নেই বিক্রেতারা

‘আমার বয়স তখন ১০ বছর। দোকানে এসে কার্টুনের বই দেখতাম। এরই মধ্যে একের পর এক ক্রেতা আসতেন। আমি আর বাবা বই খুঁজে দিতাম। দিন শেষে রাতে অনেক টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন বাবা। ফেরার সময় মাছ, মাংস, শাকসবজি ও চাল-ডাল নিয়ে যেতেন। এখন আমার বয়স ২২ বছর। গত ১২ বছরে সময় অনেক বদলে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যবসার হাল ধরেছি। প্রথম কয়েক বছর ভালো ব্যবসা হলেও গত চার-পাঁচ বছরে নেমেছে ধস। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ভালো ব্যবসার সময়টা বাবা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এখন ডাল-ভাত কেনার টাকা জোগাতে হিমশিম খেতে হয়।’

এভাবেই কথাগুলো বলেছেন কুমিল্লার মোগলটুলি এলাকার পুরনো বই বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে পুরনো বই বিক্রিতে পড়েছে ভাটা। বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ক্রেতা সংকটে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের। ইতোমধ্যে কেউ কেউ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীর মোগলটুলি ও ধর্মপুর এলাকায় পুরনো বইয়ের চারটি দোকান রয়েছে। কয়েক বছর আগেও ১০টি দোকান ছিল।

পুরনো বই বিক্রির এখনকার অবস্থা জানতে চাইলে মোগলটুলি এলাকার তরুণ বই বিক্রেতা ইসমাইল বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে এই দোকান চলছে। বাবা বই বিক্রি করতেন। তার কাছ থেকে আমি ১২ বছর ধরে বিক্রির সঙ্গে আছি। আগে পুরনো বই বিক্রি করে অনেক লাভ হতো। এখন নেই। বইয়ের দাম বেড়েছে, কাগজের দাম বেড়েছে, কালির দামও বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। পরিবার নিয়ে কোনও মতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি।’

পুরনো বইয়ের জোগাড় হয় যেভাবে

মোগলটুলি এলাকায় প্রায় ৭০ বছর ধরে পুরনো বইয়ের দোকান করছেন কাজী এরফানুল হকের পরিবার। বই বিক্রি করতেন এরফানুলের দাদা কাজী গোলাম মহিউদ্দীন। দাদা থেকে ব্যবসার দায়িত্ব নেন তার বাবা কাজী এনামুল হক খোকা। তার হাত ধরে এখন ব্যবসা করছেন এরফানুল।

দাদা পুরনো বই বিক্রি করে শহরে ঘরবাড়ি কিনেছেন জানিয়ে এরফানুল বলেন, ‘এই ব্যবসা করে বাবা ও চাচাদের লালনপালন করে বড় করেছেন দাদা। তার কাছ থেকে ব্যবসা শিখেছেন বাবা। বাবার কাছ থেকে আমি।’

পুরনো বইয়ের দোকান

পুরনো বই সংগ্রহের কথা উল্লেখ করে এরফানুল বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পুরনো বই সংগ্রহ করি। যেমন- হকার, ঢাকার বাংলাবাজার, নীলক্ষেত ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাটবাজার। আবার অনেকে পুরনো বই দিয়ে নিজের পছন্দমতো বই নিয়ে যান। এ ছাড়া আরও অনেকের মাধ্যমে বই আসে। যেমন কোনও কোম্পানি তাদের বই বিভিন্ন মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। বিখ্যাত লেখকদের বই এই মাধ্যমে আসে। কোনও ক্রেতা ভালো দামে বই বিক্রি করলে তিনি আরও অনেক ক্রেতা এনে দেন। এভাবেই চলে আসছে বই সংগ্রহ।’

পুরনো বইয়ের ক্রেতা কারা?

বরিশালের শামছুদ্দোহা চৌধুরী চাকরির সুবাদে ৩০ বছর ধরে কুমিল্লায় আছেন। তার দুই ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ছেন। ধর্মপুর এলাকার পুরনো বইয়ের দোকানি মো. রাজিবের কাছ থেকে বই কিনেছেন তিনি।

শামছুদ্দোহা চৌধুরী বলেন, ‘তৃতীয় ছেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির পুরনো বই কিনতে এসেছি। বই পুরনো হলেও পড়া কিন্তু একই। আমি কম বেতনে চাকরি করি। ছেলেমেয়ের জন্য নতুন বই কিনতে চাইলেও পারবো না। এখন বইয়ের দাম অনেক বেশি। নতুন বই কেনা আমার পক্ষে অসম্ভব। এখানের সব দোকানি আমাকে চেনেন; তাই যখনই বই কিনতে আসি, দাম কম রাখেন।’

ইসমাইল হোসেনের দোকানে চাকরির প্রস্তুতি বিষয়ক বই কিনতে এসেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ফাতেমা সুলতানা ও তাহমিনা আক্তার। তারা জানান, এসব দোকানে সব ধরনের বই পাওয়া যায়। শুধু সময় করে খুঁজে নিতে হয়। চাকরি ও যেকোনো পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য পুরনো বই খুবই ভালো। পড়া তো একই। যেসব বই এখানে না পাই, সেগুলো নিরুপায় হয়ে বেশি দামে কিনতে হয়।’

কোন ধরনের বই বেশি বিক্রি হয়?

বই বিক্রেতা রাজিব বলেন, ‘সব বয়সী মানুষই বই কেনেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স-মাস্টার্স, ধর্মীয়, স্কুল লেভেলের বই এবং গাইড মোটামুটি ভালো বিক্রি হয়। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরির পরীক্ষার পুরনো বই। এগুলোর ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়।’

পুরনো বইয়ের বিক্রিতে কেন ভাটা?

ব্যবসায় ভাটার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের এক সেট নতুন গাইডের দাম ছিল চার হাজার ৫০০ টাকা। লেকচার কোম্পানির ওই গাইডের দাম এখন পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। রয়েল গাইডের সেট ছিল পাঁচ হাজার ২০০ টাকা; এখন সাত হাজারের বেশি। ব্যবসা শিক্ষা শাখার বইয়ের সেট ছিল চার হাজার ৩০০ টাকা; এখন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। মানবিক শাখার গাইডের সেট ছিল চার হাজার ৩০০ টাকা; এখন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা।’

পুরনো বইয়ের দোকান

নতুন বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে পুরনো বই কিনতে হয় উল্লেখ করে ইসমাইল বলেন, ‘বেশি দামে কিনলেও আমরা কিন্তু ততটা বেশি দামে বিক্রি করতে পারছি না। আগে হকারদের কাছ থেকে আট টাকা কেজি দরে বই কিনতাম। পরে সেগুলো নিজেরা বাছাই করে বিক্রি করতাম। এখন সে সুযোগ নেই। কারণ কাগজের দাম বেড়েছে। হকাররা এখন আমাদের কাছে বিক্রি করেন না। তারা ৪৫ টাকা কেজি দরে ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে দেন।’  

আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে টনে টনে বই নিয়ে আসতাম জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে তেমন বই আসে না। হাতেগোনা কয়েকটা এলেও দাম দ্বিগুণ। এ ছাড়া আগে যেসব মাধ্যমে বই আসতো, তাও এখন আসে না। তারাও দ্বিগুণ দামে অন্যত্র বিক্রি করে দেন। আমরা বই পাচ্ছি কম। নতুন বইয়ের দাম বাড়ায় ক্রেতার চাপ বেড়েছে। তবে পুরনো বইয়ের সরবরাহ বাড়েনি। কাজেই ব্যবসায় ভাটা।’

বই বিক্রেতা মো. রাজিব বলেন, ‘জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বই বিক্রি কিছুটা ভালো হয়। ক্রেতাদের চাপ থাকে। সারা বছর তা আর থাকে না। আবার অনেক ক্রেতা ভিন্ন পথে বই সংগ্রহ করছেন। যেমন আমাদের কাছে যে বইটা আগে আসতো গ্রাহকের হাত ধরে, এখন তা আসে না। কারণ অনেকে অনলাইনে কিংবা আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে খুঁজে ওই বই সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এখানে আমাদের বড় ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া, পিডিএফ বই, অনলাইন ক্লাসের কারণেও অনেক ক্ষতি হয়েছে পুরনো বইশিল্পের।’

পুরনো বইয়ের দোকান

বই বিক্রেতা ইসমাইল বলেন, ‘সিলেবাস পরিবর্তনের কারণে নতুন বই দরকার হয়। পুরনো বই কাজে লাগে না। তাই আমরা বই কিনে রাখলেও তা বিক্রি হয় না। তার ওপর বাড়তি দাম। চাহিদামতো পাওয়া যায় না। কাগজের দাম বাড়ায় ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় পুরনো বই বিক্রি নেই বললেই চলে।’

আগে দিনে ৬০-৭০ হাজার টাকার বিক্রি করতাম জানিয়ে ইসমাইল আরও বলেন, ‘আগে লাভ বেশি হতো। এখন মাসেও ৬০-৭০ হাজার টাকার বই বিক্রি হয় না।। ক্রেতা আসে, বই দেখে, দাম শুনে চলে যায়। যদি নতুন বই আর পুরনো বইয়ের দামের পার্থক্য ৫০-১০০ টাকা হয়, তাহলে কেন পুরনো বই কিনবে ক্রেতারা।’

পুরনো বই বিক্রিতে সুদিন ফেরানো সম্ভব

এখনও পুরনো বই বিক্রিতে সুদিন ফেরানো সম্ভব বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালক আব্দুল হান্নান। তিনি বলেন, ‘৩৭ বছর ধরে ব্যবসা করছি। কাগজের এত দাম আগে দেখিনি। পুরনো কিংবা নতুন বই বিক্রেতা; কারও অবস্থা ভালো নেই। দোকান ভাড়া বেড়েছে, বইয়ের দাম বেড়েছে, সরবরাহ কমেছে। কিন্তু আয় সীমিত। আগের তুলনায় মানুষ বই কিনে কম। আমাদের যাওয়ার জায়গা কোথায়? যারা নতুন করে ব্যবসায় আসছেন; কেউ কেউ পাঁচ মাসেই দোকান ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ ব্যবসা নেই বললেই চলে।’

নতুন ও পুরনো মিলিয়ে কুমিল্লা শহরে ৪০টি এবং পুরো জেলায় ৪৫০টি বইয়ের দোকান আছে জানিয়ে আব্দুল হান্নান বলেন, ‘এর মধ্যে কোনও কোনও দোকানে মাসে ১০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। কিন্তু লাভের হিসাব বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমরা যারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আছি, বইয়ের দাম কমানোর জন্য লড়াই করছি। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বলছেন, আগামী জুলাই-আগস্টে কাগজের দাম কমবে। যদি কাগজের দাম কমে যায়, তাহলে বইয়ের দাম কমবে। এখন যারা পুরনো বই বেশি দামের আশায় ভাঙারি দোকানে বিক্রি করেন, তখন তারা দোকানে দেবেন। কাগজের দাম কমলে এবং ক্রেতা বাড়লে আবারও সুদিন ফিরবে এই ব্যবসায়।’