স্থানীয়রা বলছেন, এই মসজিদে মানুষ দু’হাত খুলে দান করেন। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের লোকজনকেও এ মসজিদে দান করতে দেখা যায়। এটি দেশের অন্যতম বিত্তশালী মসজিদ।
মানুষের বিশ্বাস, কোনও আশা নিয়ে একনিষ্ঠ মনে এ মসজিদে দান করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। রোগ-শোক ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষে মানুষজন এ মসজিদে মানত করে দান করেন। যুগ যুগ ধরে এ বিশ্বাস থেকেই মানুষ মসজিদটিতে দান করছেন।
২০১৭ সালে যে ক’বার মসজিদের দান বাক্স খোলা হয়েছে, প্রতিবারই মিলেছে কোটি টাকার ওপরে, সঙ্গে মিলেছে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার ও বৈদেশিক মুদ্রা। সবশেষ গত ৬ জানুয়ারি স্থানীয় প্রশাসন ও মসজিদ কমিটির নেতৃত্বে দানবাক্স খুলে এক কোটি ২৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা পাওয়া যায়। সঙ্গে পাওয়া যায় প্রচুর স্বর্ণ ও রূপার অলঙ্কার; যা এখনও পরিমাপ করা হয়নি। এছাড়াও বেশ কিছু মার্কিন ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলার, সৌদি রিয়াল, মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ও মিয়ানমারের মুদ্রাও পাওয়া যায়। সেগুলো এখনও ভাঙানো (টাকায় বিনিময়) হয়নি।
সব মিলিয়ে তিন দফায় দানবাক্স খুলে তিন কোটি ৫০ লাখ ৪ হাজার ৬৩৩ টাকা পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে রয়েছে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ ও রূপার অলঙ্কার।
২০১৬ সালে দানবাক্স থেকে পাওয়া যায় দুই কোটি ৪৫ লাখ ৫২ হাজার ৬৪৪ টাকা। এছাড়া, জমা থাকা কয়েক কেজি স্বর্ণ ও রূপার অলঙ্কার পরে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কিছু জিনিস নিলামে বিক্রি করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে ২৩৮ ভরি স্বর্ণ, যা বিক্রি করা হয়েছে ৪৯ লাখ টাকায়, ৮৬ ভরি রূপা বিক্রি করা হয় ৪৩ হাজার টাকায়। একটি হীরার আংটি বিক্রি হয়েছে ৩৮ হাজার ৬০০ টাকায়। তামা বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকায়। ৯৭২টি কুরআন শরীফ বিক্রি হয়েছে ২২ লাখ টাকায়, ৪৯ মণ মোম বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায়, কিছু বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার টাকায়।
তিন তলা মসজিদটির ভেতরে রয়েছে চারটি বড় সিন্দুক বা দানবাক্স। প্রতি শুক্রবার হাজারো মানুষ জুমার নামাজ আদায় করেন এ মসজিদে। তিন তলায়ও স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাইরের রাস্তায় নামাজ পড়তে দেখা যায় অনেককে। সপ্তাহের অন্যান্য দিনও মানুষজন দান খয়রাত করলেও শুক্রবার এর পরিমাণ হয় অনেক বেশি।
এত বিপুল অর্থ কিভাবে খরচ করা হয় জানতে চাইলে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আজিমুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষ পাগলা মসজিদে মানত করে প্রচুর দান করেন। প্রতি তিন থেকে চার মাস পর পর দান বাক্স খোলা হয়। মানুষের দানের অর্থ মসজিদটির উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়। মসজিদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। মসজিদটির একটি এতিমখানা রয়েছে, সেই এতিমখানার ছেলেমেয়েদের থাকা, খাওয়া, পোশাকসহ তাদের লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ এখান থেকেই দেওয়া হয়।’
তিনি আরও জানান, এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার মসজিদের উন্নয়ন ও সংস্কার কাজেও অনুদান দেওয়া হয়। তাছাড়া, মসজিদটির তহবিল থেকে বিভিন্ন দরিদ্র অসহায় লোকদের আর্থিক সহযোগিতা করা, চিকিৎসা সহায়তার পাশাপাশি লেখাপড়া বা বিয়ের সময় আর্থিকভাবে দুর্বলকেও সহযোগিতা করা হয়।
তিনি বলেন, ‘দানবাক্স খোলার সময় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার আমি উপস্থিত ছিলাম। পুরো মসজিদটি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকায় শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়। রূপালী ব্যাংক কিশোরগঞ্জ শাখায় পাগলা মসজিদের একটি হিসাব রয়েছে। সমস্ত টাকা এই ব্যাংকেই জমা করা হয়। বাক্স খোলার দিন ব্যাংকের লোকবলসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে সমস্ত টাকা গণনা করে পুলিশের নিরাপত্তায় ব্যাংকে নিয়ে যান। স্বর্ণালঙ্কার বা বৈদেশিক মুদ্রাগুলো পরিমাপ করা না হলেও তা মসজিদের একটি ভল্টে আগেরগুলোর সঙ্গে মজুদ রাখা হয়।’
জানা গেছে, মসজিদের সিন্দুক খোলা ও টাকা গণনা করারও একটি উপ-কমিটি রয়েছে। সেই কমিটির সদস্যরা ও পাশের মাদ্রাসার ছাত্ররা মিলে টাকা গণনায় সহযোগিতা করে থাকে। সারাদিন লেগে যায় টাকা গুনতে।
হারুয়া এলাকার আবদুল আলী বলেন, ‘পাগলা মসজিদের প্রতি মানুষের ভক্তি অন্যরকম। কোনও সমস্যা ও সঙ্কটে পড়লেই মানুষ এ মসজিদে মানত করে। নিশ্চয়ই মানুষ এ মসজিদের দান করে শান্তি পায়। নইলে মানুষ এভাবে বিশেষ একটা মসজিদে দান খয়রাত করতো না। শহরে তো মসজিদের অভাব নেই। অন্য কোনও মসজিদে তো লোকজন এভাবে দান করে না।’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এটি প্রায় আড়াইশ বছরের পুরনো একটি মসজিদ। এ মসজিদে নারীদেরও নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। নারীরা মসজিদের পৃথক স্থানে নামাজ আদায় করেন। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে প্রচুর লোক সমাগম হয়। সেদিনই দান খয়রাত বেশি করে লোকজন।
জনশ্রুতি রয়েছে, পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে থামেন। তাকে ঘিরে সেখানে অনেক ভক্তকুল সমবেত হন। ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে এই মসজিদটি গড়ে ওঠে। পরে কালক্রমে এটি পাগলা মসজিদ নামে পরিচিত হয়। কালক্রমে মসজিদটি মুসলমানদের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
প্রথমে হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির ওয়াকফকৃত মসজিদের ভূমির পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ। বর্তমানে এর পরিমাণ তিন একর ৮৮ শতাংশ। মসজিদের ব্যয়ে ২০০২ সালে মসজিদের পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা। পাগলা মসজিদের ইমরাতের নির্মাণশৈলী বেশ চমৎকার।
আরও পড়ুন-
গাজীপুরে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম ভাঙিয়ে জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার চেষ্টা
আবারও এম টি হোসেন ইনস্টিটিউট দখলের পাঁয়তারা, এলাকাবাসীর নামে মানববন্ধন