ঈদ বা উৎসবে স্বজনদের কেউ পাশে না খাকলেও মানবতার টানে কাছে আসা মানুষের অভাব হয় না। কেউ হাতে মেহেদী লাগিয়ে দেন, ফল বা রান্না করা খাবার নিয়ে কুশলাদি জানতে আসেন কেউ। যাদের সঙ্গে কোনোদিন ওঠাবসা ছিল না, আজ তারাই খুব কাছের। তাদের সঙ্গেই কাটে ঈদ-পার্বণ। তাদের কারণে দুঃখের গণ্ডি পেরিয়ে এই মহামারিকালেও বেশ ভালো আছেন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম বয়ষ্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা।
এখানকার বাসিন্দাদের ইচ্ছে একটাই। এই পুনর্বাসন কেন্দ্রই যেন তাদের আমৃত্যু ঠিকানা হয়। অনেকেই এখন পেছনের গ্লানিভরা জীবনে যেতে চান না, সেটার কথা মনেও করতে চান না।
এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেলো, তাদের বেশিরভাগই জন্মস্থান বা নিজের জেলার নাম বলতেও আগ্রহী নন। এই সেবাশ্রমটাকেই বারবার ঠিকানা বলছেন তারা। হয়তো এটাই সত্য। কিন্তু মনে মনে এও চান, তাদের মতো যেন এসব আশ্রম ‘শেষ ঠিকানা’ না হয়ে যায় অন্যদের জন্য।
সুশান্ত সেনগুপ্ত (৬৫) একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করতেন। তিনি বলেন, এখন আর রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই। শরীরের একপাশ অকার্যকর। লাঠি ভর করে হাঁটতে হয়। তবে বন্ধুরা খোঁজখবর নেন। আপাতত এই সেবাশ্রমই তার ঠিকানা বলে জানান।
কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন আছিয়া খাতুন (৮৫)। তিনি বলেন, তার দুই মেয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু খোঁজ নেয় না। নিজের কেউ না থাকলেও কিছু মানুষ তো আছেই, যারা তার একাকীত্ব দূর করেছে। তার কথা হলো, মানুষের বেঁচে থাকতে মানুষ লাগবে। সেটাই পেয়েছেন এখানে এসে।
আরেকজন শামসুল হুদা (৬৬)। জন্ম পরিচয় জানতে গেলে বলেন, ‘এসব স্মরণ করে কী লাভ? এই আব্দুল আলী সেবাশ্রমই আমার জীবন, এটাই আমার ঠিকানা। যাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি, তারা আঙুল ছেড়ে দিয়েছে।’
নতুন প্রজন্মের জন্য তার কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে নির্লিপ্ত উত্তর দেন-‘আমি আর কী বার্তা দেবো। স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বই-পুস্তক, গণমাধ্যম এসব আছে। সবখানেই পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার কথা বলা আছে। তবে এসব শিক্ষা কাজে লাগেনি। সবার আগে মানুষ হতে হবে, মানুষের মতো হৃদয় থাকতে হবে। আমার হয়তো ভুল হয়েছে। কিন্তু এ বয়সে আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কী দরকার ছিল।’
মহারাজ বেগম (৯৫) এখনও ভাবেন, তার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য স্বজনরা তাকে হাসপাতালে রেখে গেছেন। যেদিন সুস্থ হবেন সেদিন বাড়ি ফিরে যাবেন। মাঝে মধ্যে সন্তান ও নাতিরা দেখতে আসেন। তিনিই উল্টো তাদের বুঝিয়ে দেন, সুস্থ হলে ফিরবেন, তাঁর জন্য কেউ যেন চিন্তা না করে।
এই সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ড. মো. শাহজাহান দেশের বিভিন্ন জায়গায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি), যুগ্ম সচিব ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও করেছেন। ২০০৬ সালে অবসরে যান। অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে গড়ে তোলেন সেবাধর্মী এ প্রতিষ্ঠান। আপাতত ২০ জন বাসিন্দা আছেন এখানে।
ড. শাহজাহান জানান, ২০১১ থেকে প্রথমে ৪-৫ জন দুঃস্থ মানুষকে সেবাদানের মাধ্যমে এ আশ্রম চালু করেন। তিন কন্যাসহ তার স্বজনরাও এ আশ্রমে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তিনি মনে করেন, মানুষের সেবার মধ্যেই স্বর্গসম আনন্দ।
শুধু বৃদ্ধদের সেবাযত্নই নয়, আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য রেখেছেন বিনামূল্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ। ২৫টি কম্পিউটারসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত ল্যাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা এখানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ৬ মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ শেষে সনদও দেওয়া হয়।