‘পেটে কাঁচি রেখে সেলাই চিকিৎসকের ভুল, আমাদের কান্না’

পেটের ভেতর কাঁচি রেখে অপারেশন সম্পন্ন করা মনিরা খাতুনের কান্না থামছে না। কাউকে সামনে পেলেই মেয়ের কষ্টের কথা জানাচ্ছেন মা রাহেলা বেগম। রবিবার (১২ ডিসেম্বর) বিকালে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।

তবে কিছুটা লুকিয়ে সাংবাদিক ও আশপাশের রোগীর স্বজনদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেন তারা; যেন হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরা টের না পান। হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয় তলায় চিকিৎসাধীন আছেন মনিরা। চিকিৎসকরা বলছেন, তার স্বাভাবিক হতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে।

স্বজনরা বলছেন, চিকিৎসকের কাছে এটা ভুল, আর আমাদের কান্না। কষ্টের শেষ নেই মনিরার। পাঁচ মাস আগে মনিরার স্বামী সোহেল মিয়া আরেকটি বিয়ে করেছে তাকে না জানিয়ে। অসুস্থতার কারণে দিন দিন আরও জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে মনিরা। তার জীবনের সুখ নষ্ট হয়ে গেছে।

রাহেলা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়ের জীবন শেষ। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মলত্যাগের ক্ষমতা হারিয়েছে। বিকল্প পথে পাইপ দিয়ে মলত্যাগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই বছরে কবিরাজ, গ্রাম্য চিকিৎসক, পানি পড়া, এমন কিছু নেই যা করিনি। দিনের পর দিন মেয়েটা চোখের সামনে ছটফট করেছে, রোগাক্রান্ত হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারে না। ভবিষ্যতে করতে পারবে কিনা জানি না।

মনিরার ভাই কাইয়ুম মিয়া বলেন, হাসপাতালে আসার আগের দিন একজনের কাছ থেকে মাসে ২০০ টাকা সুদে ১০ হাজার টাকা ধার করে এনেছি। দুই বছর আগে ওই অপারেশনের সময় যে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল তার ১৬ হাজার এখনও পাবে একটি এনজিও। কিস্তি সময় মতো দিতে না পারায় দুই মাস আগে আমাদের নামে মামলাও দিতে চেয়েছিল সংস্থাটি। স্থানীয়দের মধ্যস্থতায় অল্প করে টাকা শোধ করছি। 

কাইয়ুম মিয়া তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি স্থানীয় গোপালগঞ্জে ইউকে ফুডের এসআর হিসেবে কাজ করেন। অল্প আয় দিয়ে  চলে ছোট ভাই মাহবুব মিয়ার লেখাপড়া, বোনের চিকিৎসা, বাবা-মায়ের যাবতীয় খরচ। তার বাবা খাইরুল মিয়া অচল, আগে কৃষিকাজ করতেন। 

মনিরা খাতুন (১৯) গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের ঝুটিগ্রামের বাসিন্দা খাইরুল মিয়ার মেয়ে। ২০২০ সালের ৩ মার্চ ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে মনিরার অস্ত্রোপচার করা হয়। ওই সময় মনিরার পেটে কাঁচি রেখে সেলাই করে দেন চিকিৎসক। পৌনে দুই বছর পর শনিবার পুনরায় অস্ত্রোপচার করে পেট থেকে কাঁচি বের করা হয়। 

এদিকে, পেটে কাঁচি রেখে সেলাইয়ের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রবিবার তিন সদস্যের এই কমিটি গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুল হাসানকে তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। অপর দুই সদস্য হলেন গাইনি বিভাগের অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা ও সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক কামরুজ্জামান। 

হাসপাতালের পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মনিরা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা উন্নতির দিকে।

রবিবার দুপুরে জেলা আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির সভায় ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা হয়। কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিকালে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিটন মিয়া হাসপাতালে গিয়ে মনিরাকে দেখেছেন। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন তিনি।

ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চিকিৎসকের গাফিলতির কারণে এমন অনভিপ্রেত ঘটনাটি ঘটেছে।

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি এম এ জলিল বলেন, শুক্রবার রাতে মনিরার পরিবারের সদস্যরা পুলিশের কাছে এসেছিল মানবিক সাহায্যের জন্য। পুলিশ শুক্রবার রাতেই মেডিক্যালে মনিরার ভর্তি ও শনিবার অস্ত্রোপচারে সহায়তা করেছে।