আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, কৃষি অর্থনীতিতে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। কৃষিপণ্যের নিরাপদ ও সহজ পরিবহন কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সেতু চালু হলে সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার পেঁয়াজ চাষিরা লাভবান হবেন সরাসরি। সদরপুরের ফল ও সবজি চাষি এবং মধুখালীর মরিচ চাষিরাও সেতুর সুফল পাবেন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন সেতু চালু হলে শুধু চাষিদের উপকার হবে না, এতে বাজার ভারসাম্যও রক্ষা হবে। বিভিন্ন এলাকায় সহজেই উৎপাদিত ফসল পৌঁছানোর সুযোগে কম দামে পেঁয়াজ, সবজি ও বিভিন্ন ফল খেতে পারবেন সাধারণ মানুষ।
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে বাড়বে পেঁয়াজের উৎপাদন
স্থানীয় চাষি ও কৃষি বিভাগ জানায়, দেশের মধ্যে ফরিদপুর জেলা পেঁয়াজ উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে শুধু সালথা ও নগরকান্দা উপজেলাতেই যে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয় তা বাকি সাত উপজেলার সমান। তবে পচনশীল এই মসলা জাতীয় পণ্য বাধ্য হয়েই অনেক সময় কম দামে বিক্রি করে দিতে হতো প্রান্তিক চাষিদের, যা আগামী মৌসুমে থেকে আর করতে হবে না। পদ্মা সেতু দিয়ে সহজেই রাজধানীসহ পাশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাবে সালথা-নগরকান্দা তথা ফরিদপুরের পেঁয়াজ।
সরেজমিনে সালথার কয়েকটি এলাকা ঘুরে পেঁয়াজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছরে মাঠের কৃষক এক মণ পেঁয়াজের দাম পেয়েছেন ৯০০-১০০০ টাকা, খুব ভালো মানের পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ১১০০ টাকা দাম উঠেছে। তবে মণপ্রতি ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকা দাম পেলে চাষিরা বাঁচতো।
চাষিরা জানান, জেলায় দুই ধরনের পেঁয়াজ চাষ হয়। বেশিরভাগই হালি পেঁয়াজ। আর কিছু চাষ হয় মুড়িকাটা জাতের। এই পেঁয়াজ একেবারেই সংরক্ষণ যোগ্য নয়। দ্রুত পচনশীল এই পেঁয়াজ চাষিরা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করে দিতেন। অনেক সময় তাদের খরচের পয়সাও উঠে না। হালি জাতের পেঁয়াজও বৃষ্টির পানি পেলে বা শুষ্ক স্থানে সংরক্ষণ করা না গেলে নষ্ট হয়ে যেতো। তাই বাধ্য হয়েই কম লাভে অথবা উৎপাদন মূল্যে মাঝারি ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করে দিতে হতো।
সালথা উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের জয়ঝাপ গ্রামের আবু নাসের বলেন, বর্তমানে চাষিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজধানীতে পেঁয়াজ পৌঁছানো। মাওয়া কিংবা পাটুরিয়া ঘাটে দিনের পর দিন ট্রাক আটকে থাকে। এতে খরচ বাড়ে আবার অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়। দেখা যায় অনেক সময় পথে যে খরচ হয়, পরে পেঁয়াজ বিক্রি করেও তা উঠে আসে না। পদ্মা সেতু চালু হলে সে ভয় আর থাকছে না। এতে চাষিরা লাভবান হবেন।
সালথার রামকান্তপুর এলাকার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সুনীল দাস বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে পেঁয়াজ ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য মোকামে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হবে। এতে ব্যবসায়ীরা দুইভাবে লাভবান হবেন। প্রথমত- ফেরিঘাটে ট্রাক আটকে থেকে পেঁয়াজ নষ্টের ভয় থাকবে না, দ্বিতীয়ত- তিন-চার দিন সময় লাগিয়ে ট্রাকে করে ঢাকায় পেঁয়াজ পৌঁছানোর ঝামেলা থাকবে না।
স্থানীয় আড়তে কম দামে বিক্রি করতে হবে না মরিচ
ফরিদপুর মরিচের জন্যও বিখ্যাত। জেলার মধুখালী উপজেলাতে মরিচের ব্যাপক আবাদ হয়। মধুখালীর মরিচ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। এ এলাকার মরিচের ঝাল বেশি হওয়ায়, এর চাহিদাও প্রচুর।
উপজেলার কাটাখালী গ্রামের চাষি আব্দুস সাত্তার শেখ বলেন, আমাদের এলাকায় মরিচের আবাদ বেশি হয়। উৎপাদিত মরিচ সাধারণত মধুখালী আড়তেই কেনা-বেচা হয়। আবার অনেকে ঢাকায়ও নিয়ে যান। তবে দাম একটু বেশি পেলেও ঢাকায় নেওয়ায় ঝুঁকি বেশি। ফেরিঘাটে দীর্ঘ যানজটের কারণে মরিচ অনেক সময় পচে যায়। তাই আমরা ঝুঁকি না নিয়ে এলাকার আড়তেই কম দামে বিক্রি করে দেই। অবশ্য পদ্মা সেতু হওয়ায় ট্রাকে করে মরিচ নিয়ে ঢাকায় বিক্রি করা সহজ হবে।
মধুখালীর মরিচ আড়তদার আশরাফ হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা মরিচ কিনতে মধুখালী আড়তে আসেন। তবে বড় সমস্যা ছিল নদী পারাপার। মরিচ কিনে ঘাটে গিয়ে দুই-তিন দিন বসে থাকতে হতো। এতে অনেক সময় মরিচ নষ্ট হয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ফল ও সবজিতে মিলবে ন্যায্যমূল্য
জেলার সদরপুর উপজেলায় বাঙ্গি ও বিভিন্ন সবজির আবাদ হয়। বিশেষ করে পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে প্রতিবছর উপজেলা জুড়ে বাঙ্গি ও লালমির চাষ করেন চাষিরা। এসব বাঙ্গি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও হাট-বাজারে রফতানি হয়। কাটাখালীর বাঙ্গি ব্যবসায়ী শেখ সামাদ বলেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙ্গি পাঠানো হয়। আমাদের বাজারে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে বাঙ্গি কিনে নিয়ে যান। তবে নদী পারাপারের কারণে অনেকে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
সদরপুর উপজেলা কৃষি অফিসার বিধান রায় জানান, এবার রমজানের সময় উপজেলায় ৮৯১ হেক্টর জমিতে বাঙ্গি ও লালমির চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর দামও ভালো পেয়েছেন চাষিরা। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানীতে দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য পাঠানো সহজ হবে। এতে চাষিরা লাভবান হবেন।
দাম কমবে পেঁয়াজ ও সবজির
এদিকে সেতু চালু হলে চাষিরা নিজ উদ্যোগেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্য পাঠাতে পারবেন। এতে পেঁয়াজ, সবজি, ফলসহ বিভিন্ন পচনশীল কৃষিপণ্য কম দামে ভোক্তার হাতে পৌঁছাবে।
মধুখালী উপজেলার বাগাট গ্রামের পেঁয়াজ চাষি দেবাশীষ দাস বলেন, ফেরিঘাটে যানজটের কারণে আমরা পেঁয়াজ নিয়ে ঢাকায় যেতে ভয় পেতাম। সেতু চালু হলে আমরা কয়েকজন চাষি মিলেই ট্রাকে করে ঢাকায় পেঁয়াজ নিয়ে বিক্রি করতে পারবো। এতে যেমন আমরা লাভবান হবো, তেমনি রাজধানীবাসীও কম দামে পেঁয়াজ পাবেন।
সদরপুরের ঢেউখালী এলাকার বাসিন্দা সবজি চাষি গোলাম মাওলা বলেন, আমাদের এলাকায় বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়। ব্যবসায়ীরা এসে সবজি কিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠান। আমাদের থেকে ব্যবসায়ীরা বেগুন প্রতিকেজি ১০ টাকা দরে কিনে নেন। সেই বেগুনই ঢাকায় নিয়ে বিক্রি হয় ৬০ টাকা দরে। সেতু চালু হলে আমরা সরাসরি ঢাকায় সবজি বিক্রি করতে পারবো। এতে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার সাধারণ ক্রেতারা কম দামে সবজি পাবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী বলেন, ফরিদপুর পেঁয়াজের জন্য বিখ্যাত। এখানকার চাষিরা পেঁয়াজ, পাট, সবজি, মরিচসহ বিভিন্ন সবজি আবাদ করেন। রাজধানীতে পৌঁছানোর নানা সমস্যার কারণে চাষিরা উৎপাদিত ফসল কম দামে এলাকার আড়তে বিক্রি করতেন। পদ্মা সেতু চালু হলে সেই চিত্র বদলে যাবে। এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।