‘প্রিয় মানুষকে হারিয়ে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম’

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে অভিভাবক হারালেন ফরিদপুর-২ আসনের বাসিন্দারা। একই সঙ্গে বর্ষীয়ান নেতৃত্ব হারালেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো বলে জানিয়েছেন জেলার নেতারা।

রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) রাত ১১টা ৪০ মিনিটে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন সাজেদা চৌধুরী।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা-সালথা ও সদরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন) আসনের সংসদ সদস্য। তার মৃত্যুতে সালথা-নগরকান্দা উপজেলার নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছে।

নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. বেলায়েত হোসেন মিয়া বলেন, ‘সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছিলেন আমাদের অভিভাবক। তার মৃত্যুতে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম। কোনোভাবেই তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। অবহেলিত সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার উন্নয়নে তিনি কাজ করে গেছেন এতদিন। আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেলাম।’

আরও পড়ুন : বেলা ১১টায় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সাজেদা চৌধুরীর জানাজা

নগরকান্দা উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বোরহান আনিস বলেন, ‘দেশ একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদকে হারিয়ে ফেললো, পাশাপাশি আমরা হারালাম আমাদের মাতাকে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। সালথা-নগরকান্দার মানুষের জন্য অনেক করেছেন। আমরা তার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। মায়ের মতো অভিভাবক হারিয়ে আমরা এতিম হয়ে গেলাম।’

সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্ষীয়ান নেত্রীকে হারিয়ে এখন আমরা অভিভাবকশূন্য। আমাদের কোনও দাবি-দাওয়া চাওয়ার মতো আর কেউ থাকলো না। আমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলামাত্রই তিনি ব্যবস্থা নিতেন। এখন আমরা কার কাছে বলবো দুঃখের কথা! অভিভাবক হারালাম।’

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক (বাঁয়ে) ও সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ইশতিয়াক আরিফ

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইশতিয়াক আরিফ বলেন, ‘একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদকে দেশ হারালো, আমরাও হারালাম এলাকার অভিভাবক। তার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো।’

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের অসুস্থতার কারণে সম্প্রতি তার নির্বাচনী এলাকা নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর পর সোমবার এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই রবিবার মধ্যরাতে চলে গেলেন তিনি।

সাজেদা চৌধুরী ১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ ও মা সৈয়দা আছিয়া খাতুন।

শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্বামী রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী গোলাম আকবর চৌধুরী। ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর তার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।

সাজেদা চৌধুরী ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেসকো ফেলোশিপপ্রাপ্ত হন এবং একই সময়ে বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনার হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক সনদ সিলভার এলিফ্যান্ট পদক লাভ করেন। তিনি ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক ওমেন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

আরও পড়ুন : সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী আর নেই

রাজনৈতিক জীবন
১৯৫৬ সাল থেকে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৯-১৯৭৫ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালক, ১৯৭২-১৯৭৬ সময়কালে বাংলাদেশ গার্ল গাইডসের ন্যাশনাল কমিশনার এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ফরিদপুর-২ আসন (নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এই অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা হন।

আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা উচ্চ রক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে আগস্ট মাসের শেষের দিকে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন।