গাজীপুরের নদী-খাল-বিলের পানি ব্যবহার অযোগ্য

গাজীপুরের নদী, খাল ও বিলের পানি অনেক আগেই মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সেই পানি এখন ফসলের জন্যেও ব্যবহার উপযোগী নেই। দিনের পর দিন কল-কারখানার নির্গত দূষিত বর্জ্যে পানি ব্যবহারের অযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। বিষাক্ত রাসায়নিক পানি একত্রিত হয়ে তুরাগে পড়ছে।

সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি এলাকায় লবলং খালে কারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলে পানি প্রবাহ বন্ধ এবং পরিবেশ দূষণ সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘শিল্পায়নের যে প্রাইস বা মূল্য এটা স্থানীয় লোকেরা দিচ্ছে। এক সময় সারা বাংলাদেশই দেবে। বাংলাদেশের আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এইখান থেকে আসে।’

গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার স্থানীয় যুবক আলিফ মিয়া বলেন, ‘লবনদহ খালটি শ্রীপুর থেকে উৎপন্ন হয়ে সদর উপজেলার বানিয়ারচালা, ভবানীপুর হয়ে মির্জাপুরে গিয়ে শালদহ নদীতে মিশেছে। শালদহ নদীতে প্রবাহিত হয়ে বিষাক্ত বর্জ্য তুরাগে গিয়ে পড়ছে।’

Gazipur-3

ভবানীপুর এলাকার গৃহিণী ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘নাকে-মুখে রুমাল দিয়ে রাখতে হয়। বর্ষাকালে কালো পানি কিছুটা রঙ বদলায়। ঈদের ছুটিতে কারখানা বন্ধ থাকলে পানি সাদা হয়। কারখানা খোলা হলের আবার পানির রঙ কালো হয়ে যায়।’

বানিয়ারচালা গ্রামের যুবক রায়হান বলেন, ‘১২ বছর আগেও লবনদহ খালের সরু সেতুর ওপর এলাকার মানুষ অবকাশ যাপন করতে যেতো। খালে প্রবহমান ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে-মুখে লেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এ খাল দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা ও গাজীপুরের শ্রীপুর এবং সদর উপজেলার অধিকাংশ কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য প্রবাহিত হয়।’

শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাইরে খেলাধুলা করতে বের হলেই ঝাঁঝালো গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। এরকম দুর্গন্ধ অব্যাহত থাকলে মানুষ বাঁচবে না।

Gazipur-2

স্থানীয় কৃষক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘কারখানার রাসায়নিক পানির বৈশিষ্ট্য এমন যে, বৃষ্টির পানিতে বেড়ে যাওয়া খালের পানি জমির পানির সঙ্গে মিশে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। শুষ্ক মৌসুমে রাসায়নিক পানির দুর্গন্ধের তীব্রতা এলাকার বাতাসকেও দূষিত করে তোলে। আগে আমি নিজেই চাষাবাদ করতাম। বছর দশেক ধরে জমি বর্গা দিয়েছি। পানি বিষাক্ততা হওয়ায় নিজে আর চাষাবাদ করি না। খালে নেমে যাওয়ার ভয়ে গবাদিপশুগুলো উন্মুক্ত ছেড়ে দিয়ে পালন করতে পারি না।’

শ্রীপুর উপজেলা জাতীয় নদী রক্ষা কমিটির সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, ‘লবলং খালের পানি ছিল স্বচ্ছ, খুব সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেতো। বর্তমানে দখল ও দূষণের কারণে মাছ তো দূরের কথা কোনও জলজ প্রাণির অস্তিত্ব নেই। একদিকে দূষণ অন্যদিকে দখল, এ দুই মিলে আজ লবলং খাল বিলুপ্তির পথে। দখল ও দূষণ মুক্ত করার জন্য নদী রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন দরে প্রশাসনকে বলে আসছি। কিন্তু দৃশ্যমান কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।’

Gazipur-4

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশননের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পরিবেশের মূল দূষণকারী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের যে নিদারুণ অবহেলা সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। গাজীপুরের যে পানি সেটা বিষাক্ত হয়ে গেছে। এই জনপদ একটা বিষাক্ত জনপদে পরিণত হয়ে গেছে। শিল্পায়নের যে প্রাইস বা মূল্য এটা স্থানীয় লোকেরা দিচ্ছে। এক সময় সারা বাংলাদেশই দেবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে কখনোই বলবো না, ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ করে দেওয়া হোক। আমরা শুধু এটাই বলবো যে, ম্যানেজমেন্ট চেঞ্জ করে দেন। অথবা আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার করতে বলবো।’

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, ‘অনেক কারখানা বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করে। আমরা অতি সম্প্রতি মেঘনা নীট কম্পোজিট কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তাদের পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যানটা (পিএইচ) বন্ধ পেয়েছি। তারা (কারখানা কর্তৃপক্ষ) বলেছে, পানির লেবেলটা বাড়লে তারা প্ল্যানটা চালু করে। এটা অনেক বেশি টেকনিক্যাল বিষয়। এখন আলোচনা করা যাবে না।’