হাতে তসবি ও পরনের জুব্বা দেখে বন্ধুর লাশ শনাক্ত করলেন বন্ধু

পীরের সঙ্গে মাহফিলে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলছিলেন দুই বন্ধু। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর বন্ধুকে দোকানে বসিয়ে বাথরুমে গিয়েছিলেন অপর বন্ধু। এরই মধ্যে ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। এসে দেখেন ভবনের নিচতলা বিধ্বস্ত। পুরো ভবন ধ্বংসস্তূপ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বন্ধুর সন্ধান না পেয়ে পরিবারের লোকজনকে খবর দেন। সবাই ছুটে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে এক হাতে তসবি ও পরনে জুব্বা দেখে বন্ধুর লাশ শনাক্ত করেন আবুল বাশার।

রাজধানীর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে বন্ধুকে হারানোর এমন মর্মান্তিক বর্ণনা দিয়েছেন বাশার। ওই ভবনের নিচতলায় বিসমিল্লাহ স্যানিটারি নামে স্যানিটারি পণ্যের দোকান ছিল তার। বিধ্বস্ত ভবনের নিচতলায় চাপা পড়ে মারা যান বাশারের বন্ধু ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫)। বাবুল মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার চর বেউথা গ্রামের মৃত শেখ মো. সাহেব আলীর ছেলে। তিনি মানিকগঞ্জের সিদ্দিকীয়া দরবার শরিফের পীর ড. মো. মঞ্জুরুল ইসলামের মুরিদ ছিলেন।

আবুল বাশার বলেন, ‘২৫ বছর ধরে পুরান ঢাকায় প্রিন্টিং প্রেসে সাপ্লাইয়ের কাজ করতো বাবুল। কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে আমার দোকানে আড্ডা দিতো। মঙ্গলবার বিকালে বাবুল দোকানে আসে। তখন মানিকগঞ্জের সিদ্দিকীয়া দরবার শরিফের পীরের ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলছিল। দীর্ঘ সময় কথা বলার পর তাকে দোকানে বসিয়ে আমি বাথরুমে যাই। এরই মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনের নিচতলা ধসে পড়ে। পুরো ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ফিরে এসে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বন্ধুকে খুঁজতে থাকি। না পেয়ে তার স্বজনদের খবর দিই। আমি ছুটি যাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে এক হাতে তসবি ও পরনে জুব্বা দেখে বন্ধুর লাশ শনাক্ত করি।’

তিনি বলেন, ‘ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে বন্ধুর একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হয়তো হাতটি ধ্বংসস্তূপে রয়ে গেছে। লাশ অনেকটা বিকৃত হয়ে গেছে। চিনতে অনেক কষ্ট হয়েছে। যদি ওই সময় বাথরুমে না যেতাম তাহলে বাবুলের মতো অবস্থা হতো আমারও।’ 

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বাবুল। তাকে হারিয়ে আহাজারি করছেন স্বজনরা। বুধবার (০৮ মার্চ) ভোরে লাশ গ্রামের বাড়ি নিয়ে আসা হয়। এ সময় বাবুলের স্ত্রী নাজমা বেগম ও তিন সন্তানের কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।

ওবায়দুল হাসান বাবুল

স্বজনরা জানিয়েছেন, বাবুলের এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মরিয়ম ও ছোট মেয়ে মারিয়ার বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান সিদ্দিকীয়া দরবার শরিফ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে।

বাবুলের দুই বন্ধু জানিয়েছেন, শবে বরাত উপলক্ষে পীর ড. মো. মঞ্জুরুল ইসলামের ওয়াজ মাহফিল ছিল টাঙ্গাইলে। পীরের মুরিদ ওবায়দুল হাসান বাবুলসহ ১০ জনের একটি দলের ওই ওয়াজে যাওয়ার কথা ছিল। ওই ১০ জনের ট্রেনের টিকিট ছিল বাবুলের কাছে। কিন্তু বিস্ফোরণের ঘটনায় মাহফিলে যাওয়া হলো না কারও। লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরলেন বাবুল।

বাবুলের ভাতিজি জামাই আব্দুর রশিদ বলেন, ‘বাবুলের শরীর থেকে একটি হাত বিচ্ছিন্ন ছিল। হয়তো হাতটি দুর্ঘটনাস্থলে রয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে বুধবার ভোরে তার মরদেহ বাড়িতে আনা হয়। বাড়ি আনার পথে পীরের দরবার শরীফে সকাল ৮টায় প্রথম জানাজা হয়। সকাল ৯টায় বাড়ির পাশে চর বেউথা বায়তুল আমান জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজা শেষে চরবেউথা গ্রামে তাকে দাফন করা হয়।’

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৭ মার্চ) বিকাল পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে সাততলা একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত, আহত হয়েছেন অন্তত দেড় শতাধিক। কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন।