ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনে পাঠদান চলছে ৭০০ শিক্ষার্থীর

দীর্ঘ দিন ধরে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার লক্ষ্মীনারায়ণ বালক-বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান চলছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে। ভবনটি জরাজীর্ণ হওয়ায় ৪টি কক্ষের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ভবনের নিচতলার দুটি কক্ষে ও পার্শ্ববর্তী একটি মন্দিরের দুটি কক্ষে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছেন শত শত শিক্ষার্থী। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।

ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল দুটি হলো- ২৭নং লক্ষ্মীনারায়ণ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২৬ নং লক্ষ্মীনারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুল দুটির কার্যক্রম একটি ভবনে চলছে।

স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৭ সালে স্কুল দুটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দুতলা একটি ভবনের ৭টি শ্রেণিকক্ষে প্রায় ৭শ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতো। এদের জন্য দুই শিফটে ১৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। তবে ২০১৫ সালে ভূমিকম্পে স্কুলের দ্বিতীয় তলার দুটি কক্ষে ফাঁটল দেখা দেয় ও পলেস্তারা খসে পড়ে। এতে ভবনের দুটি কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পরে ২০১৮ সালে ফের ভূমিকম্পে আরও দুটি শ্রেণিকক্ষে ফাঁটল দেখা দেয়। ভবনের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়ে। সিঁড়ি কোঠার পলেস্তারা খসে পড়ে। বৃষ্টি হলে ছাদ বেয়ে পানি পড়তো। এক পর্যায়ে দ্বিতীয় তলার ছাদ ধসে পড়ার আশঙ্কায় বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে ভবনের ৪টি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। এই অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে স্কুল ভবনের নিচ তলার দুটি কক্ষে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। পরে শ্রেণিকক্ষ সংকটে ২০২৩ সাল থেকে পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর মন্দিরের ভেতরে দুটি কক্ষে বিদ্যালয়ের আংশিক পাঠদান কার্যক্রম চলছে। তবে স্কুল থেকে মন্দিরে যাতায়াত করতে অনেক সময় ব্যয় হয়। তাছাড়া স্কুল ও মন্দিরের সড়কে যাতায়াতের সময়ে শিশু শিক্ষার্থীদের দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মন্দিরে পুজোর সময় ঢাক-ঢোলের শব্দে পড়াশোনা করতে বেশ সমস্যা হয়। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা ও দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দুই শিফটে স্কুল ভবনে ও মন্দিরে চলছে পাঠদান কার্যক্রম।

ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী নবনীতা সাহা বলেন, স্কুল ভবন কখন ভেঙে পড়বে এই ভয়ে থাকি। এই ভয়ে আমরা স্কুলে খেলাধুলা করতে পারি না, আনন্দ করতে পারি না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়াশোনায় মন বসে না।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সনদ সাহা বলেন, আমাদের স্কুলের ছাদ ফেটে ও ভেঙে গেছে। ধসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। ছাদের অংশ বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে স্কুলের কক্ষে ক্লাস করতে ভয় পাই। তাছাড়া স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার ফলে অনেকগুলো কক্ষ বন্ধ রাখা হয়েছে। তাই বন্ধ করে রাখা কক্ষের ক্লাসগুলো মন্দিরে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে অভিভাবক পারমিতা রানী বলেন, স্কুলের ছাদ ও সিঁড়ি ভেঙে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এগুলো কোন সময় আমাদের সন্তানদের উপরে পড়বে কে জানে। এ নিয়ে সব সময় ভয়ে থাকি। এর মধ্যে শ্রেণিকক্ষ সংকটের ফলে মন্দিরে গিয়ে বাচ্চাদের ক্লাস করতে হয়। ফলে আমাদের দাবি, স্কুলটা খুব দ্রুত মেরামত করা হোক।

দুর্ঘটনার ভয়ে আতঙ্কে থাকা অভিভাবক রাকিব সাহা বলেন, সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি না। সব সময় আতঙ্কে থাকি, কখন জানি কী হয়ে যায়। এই ভবনে যে কোনও মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেই দায় কে নেবে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এখনও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এ বিষয়ে ২৭নং লক্ষ্মীনারায়ণ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার বলেন, ১৯৮৫ সালের পুরনো এই ভবনটিতে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে দুই দফায় ভূমিকম্পে ৪টি কক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে এগুলোতে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে শ্রেণি কক্ষ সংকটের ফলে পার্শ্ববর্তী মন্দিরে আংশিক পাঠদানের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এই ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকা ৭শ শিক্ষার্থীকে মন্দিরে ও স্কুলে মিলিয়ে ক্লাস চালানো প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, ডিসি, মেয়রসহ বিভিন্ন দফতরে গিয়েছি।

২৬ নং লক্ষ্মীনারায়ণ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপসী সাহা বলেন, ভাঙা ও জরাজীর্ণ ভবনের কারণে আমাদের ছাত্র সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে অভিভাবকরা অন্যত্র তাদের সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা অতিদ্রুত নতুন ভবন চাই।

মন্দিরের ভেতরে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের পুরোহিত দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, শিক্ষক ও এলাকাবাসীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মন্দির ভবনের দুটি কক্ষ ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘ ২ বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও স্কুল ভবনটির সংস্কার বা নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়নি। তাছাড়া মন্দিরের পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় নানা সমস্যা হয়।

স্কুল দুটির কল্যাণ কমিটির সভাপতি দিদার খন্দকার বলেন, খুব ঝুঁকিপূর্ণ ও নাজুক অবস্থায় ছেলে-মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করছে। বিগত কমিটির লোকজন এ বিষয়ে তেমন কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে এবার আমি কমিটিতে আসার পরে শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরে গিয়েছি। তবে স্কুলের জায়গা নিয়ে একটি মামলা ছিল। দীর্ঘদিন আইনি লড়াই করে সেই মামলায় জয় হয়েছে। আশা করি, খুব শিগগিরই ভালো খবর পাবো।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফেরদৌসী বেগম বলেন, স্কুলটা একটা জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। তবে স্কুলটির জমি সংক্রান্ত একটি মামলা ছিল। ইতিমধ্যে সেই মামলা নিষ্পত্তি হলে নতুন ভবন করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেই কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, লক্ষ্মীনারায়ণ স্কুলের ঝুঁকির বিষয়টি দেখবো। এ বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের মতামত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।