খুলনায় ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলা, কৃষকরা হতাশ

খুলনায় ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে আমন বীজতলাআমনের চলতি মৌসুমে এমনিতেই বীজের সঙ্কট রয়েছে খুলনা জুড়ে। তার ওপর গত এক সপ্তাহের টানা বর্ষণে বিভিন্ন এলাকায় পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে আমন বীজতলা। এতে করে চাষিরা হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে মৎস্য ঘের। হুমকীর মুখে রয়েছে ফুলতলা উপজেলার বিল ডাকাতিয়ার চিংড়ি ঘের। বৃষ্টিতে কয়রা উপজেলায় বেড়িবাঁধে ধস নেমেছে। টানা বৃষ্টিতে খুলনা অঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপ-পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘বিএডিসি থেকে আগে খুলনার জন্য ১ হাজার টন বীজ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এ বছর সরবরাহ করা হয়েছে ৮শ’ টন। ২শ টন বীজ কম সরবরাহ করায় আমন বীজের সঙ্কট রয়েছে। তারওপর অতিবৃষ্টিতে বীজতলা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হওয়ায় সঙ্কট তীব্র হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর খুলনায় প্রায় ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে হবে উফশী জাতের ধান চাষ। অবশিষ্ট জমিতে থাকবে স্থানীয় জাতের ধান।’

আব্দুল লতিফ বলেন, ‘এ বছর কৃষকদের কাছে থাকা বীজ ধানের সদ্যবহার, বিএডিসি থেকে বরাদ্দকৃত ধানের বীজ ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত বীজ দিয়ে এ সঙ্কট মোকাবেলায় কৃষি বিভাগ তৎপর রয়েছে।’

এদিকে ডুমুরিয়া উপজেলার অর্ধশত হেক্টর জমির আমন বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার ৫ শতাধিক কৃষকের অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন উপজেলা কৃষি অফিস। ফুলতলা উপজেলার বিল ডাকাতিয়াসহ অধিকাংশ বিলের আমন ধানের বেশিরভাগ বীজতলা তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে বিল ডাকাতিয়ার চিংড়ি ঘেরগুলো প্রায় ডুবো অবস্থায় রয়েছে। উপজেলার ৪ ইউনিয়নের সব এলাকার বীজতলা এখন পানির নিচে।khulna

পাইকগাছা উপজেলার পৌর সদরসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে চিংড়ি ঘের, পুকুর, জলাশয়ের মাছ ও চিংড়ি ভেসে গেছে। চলতি মৌসুমের আমন বীজতলায় হাটু পানি। ক্ষেতের ফসল তলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতিতে কৃষক দিশেহারা। অবিরাম বর্ষণে কয়রা উপজেলার পাউবোর বেড়িবাঁধের ১৫টি পয়েন্টে ধস নেমেছে।

পাউবোর ১৩/১৪-১ ও ১৩/১৪-২ পোল্ডারের দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা, চোরামুখা, উত্তর বেদকাশির রত্না, কাটকাটা ও গাজীপাড়া, কয়রা সদরের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে কাছাড়িবাড়ী, মহারাজপুরের দশহালিয়া, লোকা, মঠবাড়ি পবনা ও মহেশ্বরীপুরের নয়ানী এলাকার বেড়িবাঁধে ভয়বাহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বেড়িবাঁধ যেকোনও মুহূর্তে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কয়রা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আখম তমিজ উদ্দিন ও নির্বাহী অফিসার মো. বদিউজ্জামান বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের জন্য বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল। গত ৭ দিনের অতিবৃষ্টিতে এরমধ্যে প্রায় ৫০ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়েছে।

ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষকদের মধ্যে বরুনার সবুর শেখ, শোলগাতিয়ার আ. কাশেম, খরসঙ্গ এলাকার আবুল কালাম শেখ, রোস্তমপুরের মহিউদ্দিন মোড়ল, পঞ্চু এলাকার সুভাষ মণ্ডল জানান, বিভিন্ন বিলে থাকা খাল বা জলাশয় সরকারিভাবে সম্প্রতি ইজারা দেওয়া হয়। ইজারা নিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ওই খাল বা জলাশয়ে ইচ্ছামতো বাঁধ বা পাটা দিয়ে মাছ চাষ করছে। অপরদিকে জমির মালিকরা তাদের জমিতে বাঁধ দিয়ে গড়ে তুলেছেন অপরিকল্পিত মৎস্য ঘের। পানি নিস্কাসনের ব্যবস্থা না থাকায় একটু বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। তলিয়ে যায় বীজতলাসহ আমন ফসলি জমি।

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার মো. নজরুল ইসলাম জানান, ডুমুরিয়ায় গত ১৯ জুলাই থেকে ২৫ দুপুর জুলাই পর্যন্ত ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অতিবৃষ্টির ফলে তলিয়ে যাওয়া বীজতলার পানি নিস্কাসনের জন্য কৃষককে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আশেক হাসান বলেন, কৃষকের ক্ষতি করে নেট পাটা দিয়ে মাছ চাষ করতে দেওয়া হবে না।

ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান আলী মুনসুর বলেন, ইতোমধ্যে স্থানীয় চেয়ানম্যানকে সঙ্গে নিয়ে শোভনা, শিবপুর, বাদুরগাছাসহ বিভিন্ন এলার বেড়িবাঁধ কেটে পানি নিস্কাশন করা হয়েছে।

ফুলতলা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১২টি ব্লকে ১০৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়। বর্তমানে ১২টি ব্লকের সম্পূর্ণ বীজতলা পানির নিচে। ব্লকগুলো হলো- বিল ডাকাতিয়াসহ জামিরা, ছাতিয়ানি, ধোপখোলা, গাড়াখোলার দক্ষিণ অঞ্চল, বরনপাড়া, মশিয়ালীর দক্ষিণ অঞ্চল, শিরোমনি ডাকাতিয়া, ফুলতলা ইউনিয়নের যুগ্নিপাশা ও পায়গ্রামের অংশ।
পাইকগাছা উপজেলা কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অতি বৃষ্টিতে হরিঢালী, কপিলমুনি, গড়ইখালী, দেলুটিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের ১শ হেক্টরের অধিক আমন বীজতলা তলিয়ে গেছে। এ মৌসুমে বীজের ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা নেই। তবে, তারা কৃষকদের টিনের গোলা বা বাড়িতে সংরক্ষিত ভোজধান থেকে বীজতলা বানানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
khulna-1

কয়রা গ্রামের কৃষক আ. বারিক বলেন, কয়রায় এমনিতেই আমন বীজের ব্যাপক সংকট। তার ওপর বৃষ্টিতে বীজতলা নষ্ট হয়েছে।

উপজেলা মৎস্য অফিসার এসএম আলাউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, উপজেলার প্রায় ১ হাজারের বেশি মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনের চেষ্টা চলছে।

কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, গড়িয়াবাড়ি স্লুইস গেটের পার্শ্বে গর্ত হয়ে ভাঙন সৃষ্টি হলে এলাকবাসির সহযোগিতায় আপাতত মেরামত করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্যাহ আল মামুন লাভলু বলেন, দশহালিয়া এলাকার বেড়িবাঁধ ভয়াবহ ধসের কারণে ২৫/৩০ ফুট এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। লবণ পানিও প্রবেশ করেছে এলাকায়। খবর পেয়ে এলাকাবাসিকে নিয়ে বাঁধরক্ষা করা হলেও তা রয়েছে হুমকির মুখে।

উত্তর বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ সরদার নুরুর ইসলাম বলেন, কাটকাটা বাজারের পাশে রত্নার বেড়িবাঁধের সিংহভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানকার লোকজন ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।
পাউবোর আমাদী সেকশান কর্মকর্তা মোঃ খায়রুল আলম বলেন, ‘এলাকা পরিদর্শন করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

/এআর/