৭ মার্চের ভাষণেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল নড়াইলের মুক্তিকামী জনতা

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশকে শত্রু মুক্ত করার আহ্বান জানান। তার সেই ভাষণে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা। এরপর তারা প্রস্তুতি নিয়ে লড়াইয়ে নামে। ৯ মাসের লড়াই শেষে  ’৭১ সালের  ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় নড়াইল জেলা।

মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়,নড়াইলের তৎকালীন এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দফতর করা হয়েছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এসডিও, আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল বাহিনী গঠন করে যশোরে পাঠিয়ে দেন। ৬ এপ্রিল সকালে হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে। এরপরই শহর ছাড়তে শুরু করে লোকজন। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্ল মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের কাছে নিয়ে হত্যা করে। ওই সময় পিস কমিটির জেলা সভাপতি মাওলানা সোলাইমানের নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী গঠিত হয়। তার নির্দেশে জল্লাদ ওমর ও ওহাব মুক্তিকামী ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করে চিত্রা নদীতে ফেলে দিত।

এদিকে, লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িয়ারায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ২৩ মে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের সহযোগিতায় ইতনা গ্রামে ঢুকে ১৯ নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে।

মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে নড়াইলে মুক্তিযোদ্ধাদের  শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই হয়। শুধু নড়াইল চিত্রা নদীর পাড়ে (প্রধান ডাকঘরের পাশে) ৩ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে হানাদর বাহিনী ও রাজাকাররা। এছাড়া নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর গ্রামের তরফদার পরিবারের স্কুলশিক্ষক আতিয়ার রহমান তরফদার, আব্দুস সালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার ও আলতাব তরফদার এবং মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা ও মকবুল হোসেন সিকদারকে ধরে এনে নড়াইল শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেতরে হত্যা করে কবর দেওয়া হয়।

দেশ হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে সদর থানায় উজির আলী খান, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী ও কালিয়া থানায় ওমর আলীকে এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অক্টোবরে জেলার মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে যে হানাদার বাহিনী আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বরের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়ায় থাকা পাকিস্তানি বাহিনীকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডাররা আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তারা তা না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে তাদের আক্রমণ করে। পরে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এসএম ফজলুর রহমান জিন্নাহর নেতৃত্বে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের  দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে রাজাকারদের ওপর হামলা চালায়। ওই দিনের যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান শহীদ হন। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আব্দুল হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালানো হয় হানাদার বাহিনীর ওপর। পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা হামলা চালালে মতিয়ার রহমান শহীদ হন। ওই দিনই শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোয় থাকা ৪০ জন পাকিস্তানি সেনাকে আত্মসমর্পণ করতে বললে তারা অস্বীকৃতি জানায়। এরপর মুক্তি বাহিনীর চারদিক থেকে ঘিরে প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ শুরু করলে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।  এরপরই সারা শহরে বিজয় মিছিল শুরু হয়। ১০ ডিসেম্বর  দুপুরে নড়াইলকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে।

মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পেয়েছেন। তারা হলেন,  বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান।

আজ নড়াইল মুক্ত দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে  মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, বধ্যভূমি ও গণকবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও দোয়া অনুষ্ঠান, র‌্যালি  এবং আলোচনা সভা।