মোংলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে টয়লেটের ৭৭ লাখ টাকা হরিলুট!

আশ্রয়ণ প্রকল্পের এই ঘর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী

মোংলায় সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক আশ্রয়ণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ‘জমি আছে ঘর নেই, নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীন এ প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। এ প্রকল্প নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও উপকারভোগীদের মধ্যে রয়েছে নানা ক্ষোভ। গৃহ নির্মাণে অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বাগেরহাট জেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য হাবিবুন নাহার।

এদিকে অনিয়মের বিষয়ে তদন্তে নেমেছেন বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শাহিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘দুই-এক জায়গায় টয়লেট হয়েছে। তবে বেশির ভাগ জায়গাতেই টয়লেট নির্মাণ করা হয়নি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, তারাই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতাধীন এই ঘরগুলো শুধু অসহায় ও দুস্থ— যাদের জমি আছে, গৃহ নির্মাণের সামর্থ্য নেই, কেবল তাদেরই পাওয়ার কথা। গত ২০১৬-২০১৭ ও ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে মোংলা উপজেলায় ৪৮৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের সুবিধাগ্রহণকারী ও উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে অস্বচ্ছতা। এছাড়া অভিযোগ আছে, প্রকল্পের যে নির্দেশনা রয়েছে, তা দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিতরা লাখ লাখ টাকা হরিলুট করেছেন। যারা ঘর পেয়েছেন তাদের অনেকেরই ঘরের অবস্থা নাজুক ও নিম্নমানের। বেশির ভাগ ঘরই বসবাসের অনুপযোগী। এ প্রকল্পে প্রতিটি ঘরের সঙ্গে একটি করে টয়লেট নির্মাণের কথা থাকলেও সেখানেও হয়েছে পুকুর চুরি।

জানা গেছে, প্রতিটি ঘরের অনুকূলে টয়লেটসহ বরাদ্দ এক লাখ টাকা। এর মধ্যে ঘর সংযুক্ত টয়লেটের জন্য বরাদ্দ প্রায় ১৯ হাজার টাকা। এ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন দেখা গেছে, স্বজনপ্রীতি ও নগদ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। মোংলা উপজেলা পর্যায়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পের সভাপতি সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ঘর তৈরিতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ছাড়াও শুধু ৪৮৫টি ঘরের অনুকূলে ৪৮৫টি টয়লেটের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৭৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এ নিয়ে ঘর পাওয়া দুস্থ পরিবার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আর এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘যাতে কোনও ধরনের অনিয়ম না হয়, সেজন্য তৃতীয়পক্ষকে ঢুকতে না দিয়ে সরাসরি ঘর মালিকদের তিনটি চেকের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের দিয়েই ঘর তৈরি করিয়েছি। ঘরের সঙ্গে টয়লেটও করা হয়েছে। যে যে জায়গায় টয়লেট হয়নি, সেখানে ঘর মালিকেরা করেনি।’ টাকাপয়সা নিয়ে কোনও অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

প্রকল্পের অনিয়ম প্রসঙ্গে উপজেলার মিঠাখালী ইউপি চেয়ারম্যান ইস্রাফিল হাওলাদার জানান, ‘তার ইউনিয়নে ১৫০টি ঘর বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু কীভাবে উপকারভোগীদের তালিকা হয়েছে তা তিনি জানেন না। এছাড়া, ঘর নির্মাণের বরাদ্দ এবং কোন প্রক্রিয়ায় ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তাও কাউকে অবগত করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘টয়লেটসহ স্বাস্থ্যসম্মত এসব ঘর নির্মাণের কথা থাকলেও তার ইউনিয়নে যেসব ঘর বরাদ্দ ও নির্মাণ করা হয়েছে, তার একটিতেও টয়লেট নেই।’

এই প্রকল্পে একটি ঘর পেয়েছেন মোংলার চিলা ইউনিয়নের কলাতলা গ্রামের বিপুল মণ্ডল। তিনি জানান, তার ঘরের সঙ্গে সংযুক্ত টয়লেট তৈরি তো দূরের কথা, ঘরের বেড়ার প্রয়োজনীয় টিনও নিজে জোগান দিয়েছেন। নিজের পকেটের প্রায় ১৬ হাজার টাকা খরচ করেছেন ঘরের পেছনে।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. নাহিদুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সভাপতি ও সদস্য সচিব হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করার কথা রয়েছে। কিন্তু এখানে আমার দায়িত্ব কেবল কাগজ-কলমেই ছিল।’ কীভাবে দুস্থদের তালিকা ও ঘরগুলো তৈরি হয়েছে, তা কিছুই আমার জানা নেই বলে দাবি করেন তিনি।

মোংলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তাহের হাওলাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন— ‘জমি আছে ঘর নেই, নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণের অর্থ হরিলুট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রকল্পে এ অনিয়ম কখনও কাম্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব ঘর নির্মাণের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, একটি ঘরও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ উপযোগী করে নির্মিত হয়নি।’

আবু তাহের হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের জনৈক নৈশপ্রহরীর মাধ্যমে উপকারভোগীদের তালিকা তৈরি করা হয়। আর এ তালিকা তৈরিতেও অনিয়ম হয়েছে। উপকারভোগী ও ঘর পাওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ প্রকল্পের নানা অনিয়ম সম্পর্কে জেনেছি। পরবর্তী সময়ে খোঁজখবর নিয়ে অনিয়মের সত্যতাও পাওয়া যায়।’ তিনি জানান, গত ২১ এপ্রিল বাগেরহাট জেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রকল্পে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার। একইসঙ্গে এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করবেন বলেও ওই সভায় জানান উপমন্ত্রী।