লাখ টাকার ঘরে খরচ কত?

সরকারিভাবে তৈরি করে দেওয়া ঘরখুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ‘জমি আছে, ঘর নাই, নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঘর নির্মাণে ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করছেন ঘর পাওয়া অনেকে। এরই মধ্যে অনিয়মের অভিযোগ তুলে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছেন ঠিকাদার সরদার খান আছাবুর রহমান। বরাদ্দের চেয়ে কম খরচে গৃহ নির্মাণ, বাড়তি দাম লিখে বিল ভাউচার করা,  শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ না করা,  ঘর থাকার পরও ঘর প্রদান, সরকার সমর্থিত দলের সদস্যদের নামে ঘর বরাদ্দসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করেছেন তিনি। তবে ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহনাজ বেগম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

২০১৭-১৯ অর্থবছরে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ডুমুরিয়ায় ঠিকাদার আছাবুর ৩৯৯টি ঘর নির্মাণ করেন। ২৮ অক্টোবর দেওয়া অভিযোগপত্রে তিনি বলেছেন,  প্রতিটি ঘর নির্মাণ মজুরি, সরঞ্জামাদি পরিবহনসহ সার্বিক খরচ বাবদ ১৪ হাজার টাকা করে দেওয়ার চুক্তি হয় ইউএনওর সঙ্গে তার। এ হিসাবে ৩৯৯ ঘর নির্মাণ বাবাদ তার পাওনা দাঁড়ায় ৫৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ইউএনও এ কাজের জন্য তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকার ভাউচারে স্বাক্ষরও নেন। একইসঙ্গে ঘরপ্রতি ১৭ হাজার টাকা খরচের ভাউচারে স্বাক্ষর দিতে বলেন। কিন্তু  তিনি ওই  ভাউচারে সই করতে রাজি হননি। এ কারণে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। পরে তাকে ৪৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি ৬ লাখ টাকা তিনি এখনও পাননি।

ঠিকাদারের দাবি,  ১৭ হাজার টাকার ভাউচারে সই না করায় নানা অজুহাতে তার পাওনা ৬ লাখ টাকা দিচ্ছেন না ইউএনও। শ্রমিকদের টাকা পরিশোধে তিনি নিজের মোটরসাইকেল, বসতভিটা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। বকেয়া পেতে তিনি জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা চেয়েছেন।

ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের গোলনা এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান নিজ জমিতে একটি ঘর পেয়েছেন। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক।

তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে যখন ঘর দেওয়ার ব্যাপারে উপজেলা পরিষদ থেকে তালিকা করা হয় তখন নাম দিয়েছিলাম। দলীয় লোক হওয়ায় একটি ঘর পেয়েছি। এ ইউনিয়নে আমার মতো ১২-১৪ জন দলীয় কর্মী হিসেবে সরকারি ঘর পেয়েছেন।’

সরকারিভাবে তৈরি করে দেওয়া ঘরতিনি বলেন, ঘরের মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন তিনি।  ইউএনও’র কাছে অভিযোগও দিয়েছিলেন। এরপর ঘরে কয়েকটি বাতা বদলে দিয়ে যায়। ঘর তৈরিতে ৬৫ হাজার মতো খরচ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মিজানুরের ছেলে মেহেদী হাসান খান জানান, ঘর নির্মাণে যা মালামাল দেওয়া হয়েছে তাতে ৬০-৭০ হাজার টাকার মতো খরচ হতে পারে। ঘরের টিনের মান ভালো। বাকি মালামাল খুবই নিম্নমানের। খুলনা থেকে কর্মকর্তারা এসে ঘর উদ্বোধন করেছিলেন বলে তাদের ঘরে রঙ করা হয়েছে। অন্যান্য ঘরে তাও নেই। বৃষ্টির সময় ঘরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি পড়ে। ব্যবহারের শুরুতেই মেঝের পলেস্তারা উঠে যায়। অভিযোগ দেওয়ার পর তা ঠিক করে দেয়।

গোলনার কৃষক অজিত মোল্লা বলেন, তিনি পৈত্রিক সূত্রে ২৫ শতক জমি পেয়েছেন। যেখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করেন। জমির অপর প্রান্তে এক ছেলে ঘর করে বসবাস করছে। সরকারিভাবে তার জমিতে একটি ঘর ও বাথরুম নির্মাণ করে দিয়েছে। ১৭টি খুঁটির ঘরটি করতে ৭০-৮০ হাজার টাকার মতো খরচ হতে পারে।  ঘরের টিনের মান খুবই ভালো। কিন্তু অন্যান্য সামগ্রী কম দামি। খুঁটিগুলোর বাজার মূল্য ৭০০-৮০০ টাকা হবে। বাজার থেকে এগুলো কিনতে হলে ১৩-১৪ হাজার টাকা ব্যয় হতো। কিন্তু  খুঁটিগুলো কর্মকর্তারা তৈরি করিয়ে এনে দিয়েছেন। আর ঘর বানাতে শ্রমিক মজুরি ছিল ১৪ হাজার টাকা। নির্মাণ কাজে ফাইভ  রিং সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।  যার বাজার দর কম। সব মিলিয়ে ব্যয় ৮০ হাজার টাকার মতো হতে পারে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, একেকটি ঘর তৈরিতে রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি ও পরিবহন বাবদ ১৪ হাজার টাকা, স্যানেটারি মালামাল রিংস্লাব ও বালি ক্রয়ে ৩ হাজার টাকা, সিমেন্ট ও রড ক্রয়ে ১০ হাজার ৫০০ টাকা, ইট খোয়া ক্রয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা, সাইজ কাঠ ও বাতা ক্রয়ে ১১ হাজার ৭০০ টাকা, ঢেউটিন, মটকা ও নালা ক্রয়ে ৩০ হাজার টাকা এবং তার, পেরেক, পলিথিন ও কবজা ক্রয়ে এক হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। এ হিসাবে মোট খরচ আসে ৮২ হাজার ৭০০ টাকা।

সরকারিভাবে তৈরি করে দেওয়া ঘরঠিকাদার আছাবুর বলেন, নির্মাণ কাজের সব মালামালই সরকারি কর্মকর্তারা তাকে কিনে দিয়েছেন। তিনি কেবল তা বহন করে নিয়ে শ্রমিক দিয়ে ঘর তৈরি করিয়েছেন। মালামালের মান সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন।

অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও শাহনাজ বেগম বলেন, ‘নির্মাণ কাজ পুরো বুঝিয়ে না দেওয়ায় ঠিকাদারের এক  লাখ টাকা জমা রাখা হয়েছে। কাজ বুঝিয়ে দিলে তিনি ওই টাকা পাবেন।’

তিনি বলেন, ‘আছাবুর কত টাকা জমা দিয়েছেন আর কত টাকা আমরা তাকে দিয়েছি তার সব হিসাব আছে। আমরা কাগজপত্রে সব হিসাব রেখেছি। টাকা-পয়সার লেনদেন মুখে মুখে হয়নি। লিখিতভাবেই হয়েছে। অতিরিক্ত টাকার ভাউচারের বিষয়টি সম্পূর্ণ অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কাজে কোনও ধরনের অনিয়মের প্রশ্নই ওঠে না। কারণ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত তদারকি ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ঘর তৈরিতে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ ছিল। সেটাই ব্যয় করা হয়েছে। বিল ভাউচারে প্রমাণ আছে।’