মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে তিন মাস বন্ধ থাকার পর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে পশুর হাট খোলা রাখলেও ক্রেতা বিক্রেতার অভাবে এখন লগ্নির টাকা কীভাবে পাবেন—এই চিন্তায় দিশেহারা ইজারাদাররা। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হাটের ইজারা মূল্য ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনতে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন ইজারাদার ও খামারিরা।
হাটটির ইজারাদার নাজমুল হাসান বলেন, ‘চার কোটি ৯০ লাখ টাকার বিনিময়ে হাটটি ইজারা নেওয়া হয়েছে। প্রতি হাটে খরচ ৫০ হাজার টাকা ধরে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় হলে বছর শেষে হাট ডাকের মূল তোলা সম্ভব ছিল। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে চার হাটে উঠেছে যথাক্রমে ৩৮ হাজার, ৫৯ হাজার, এক লাখ ও এক লাখ ১৮ হাজার টাকা। মোট তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। এভাবে টাকা পেলে ইজারার টাকাই উঠবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘১০ বছর ধরে গরুর হাট চালাচ্ছি। এরকম অবস্থায় কখনও পড়িনি। দুই ঈদের আগে একমাস ধরে হাটে সর্বোচ্চ বেচাকেনা হয়। একটা ঈদ গেলো, করোনায় তখন হাট বন্ধ ছিল। আর এখন হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা কম। এ অবস্থা চলতে থাকলে মরণ ছাড়া গতি নেই।’
যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে বিক্রির জন্য পশু আনা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বেপারিরা এই হাট থেকে পশু কিনে নিয়ে যান।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনায় হাট বন্ধ ছিল, তাই পশু হাটের সঙ্গে জীবিকা নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ পুরোপুরি কর্মহীন হয়ে পড়েন। ইদানীং হাট চালু করা হলেও ক্রেতা বিক্রেতার অভাবে হাট জমজমাট হচ্ছে না।
পশুর হাটে কথা হয় সিলেটের বেপারি আওয়াল ও ঢাকার আবু তাহেরের সঙ্গে। আওয়াল প্রতি হাটে অন্তত পাঁচ ট্রাক গরু কিনলেও গত মঙ্গলবার তিনি মাত্র এক ট্রাক গরু কিনেছেন বলে জানান। করোনার কারণে এবার বিভিন্ন এলাকায় পশুর চাহিদা কম। দামও তুলনামূলক অনেক কম। তবে পরিবহন খরচটা আগের চেয়ে বেশি।
অপর ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, ‘ব্যবসায় এখন ভাটা চলছে। গরু কিনে হাটে নিয়ে বিক্রি করতে না পারলে পুঁজি হারাতে হবে, তাই সাহস করে গরু কিনতে পারছি না।’
হাট কমিটির সদস্য আবু তালেব বলেন, ‘হাটে গরু বেচাকেনা নেই। বাইরের পার্টি না এলে গরু কিনবে কে? বেপারি না আসায় অনেক খেতোয়াল (খামারি) খরচ করেও গরু হাটে আনছেন না। দায় ঠেকে কিছু খেতোয়াল গরু তুলেছেন, কিন্তু দাম পাচ্ছেন না বলে ছাড়ছেন না।’ তবে ঈদ আসার আগে কিছু গরু হাটে উঠবে বলে জানান অনেকে।
হাটে হাটে পশু বেচাকেনায় সম্পৃক্ত পশু ব্যবসায়ী সাতমাইলের মন্টু মিয়া, আনসার আলী ও সোহরাব হোসেন জানান, তারা এক হাট থেকে পশু কিনে অন্য হাটে বিক্রি করেন। হঠাৎ হাট বন্ধের পর আগেই কেনা পশু নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন তারা। এগুলো বিক্রি করতে পারছেন না।
সোহরাব হোসেন বলেন, ‘করোনায় নিজের সংসারের খাদ্যের জোগান দিতে গিয়ে যেখানে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে পশুখাদ্য কিনবো কীভাবে? ওদের খাদ্য দিতে না পারলে আবার দামও পাওয়া যাবে না। পড়েছি উভয় সংকটে। করোনার ভয়ে হাটে বেপারি আসছে না। তাই বিক্রিও নেই।’
হাট কমিটির সহ-সভাপতি ইয়াকুব হোসেন বিশ্বাস বলেন, ‘কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অন্তত ২০টি জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেপারিরা আসেন এ হাটে। করোনায় তিন মাস ধরে হাট বন্ধ, এখন খোলা থাকলেও হাটে নামমাত্র পশু উঠছে, বেচাকেনা নেই, পুঁজিও হারিয়ে যাচ্ছে। হাটের খরচের টাকা দিয়ে যা পাচ্ছি তাতে কয়েক বছরেও লগ্নি করা টাকা তোলা সম্ভব নয়।’
হাটের শুরু হয় বৈশাখ মাসে আর শেষ হয় চৈত্র মাসে। প্রতি বছর ১০০টি হাট পাওয়া যায়। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় তিনটি মাস শেষ হচ্ছে। আয় হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। সপ্তাহে ১০ লাখ টাকা আয় হলে তবে আসল টাকা তোলা সম্ভব। করোনার কারণে মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে এখন সবাই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। সরকারি সহযোগিতা না পেলে হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পথে বসতে হবে। বিষয়টি বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মণ্ডল বলেন, ‘পশুহাট সংশ্লিষ্টদের আবেদন পেয়েছি, কিন্তু আমাদের তো বিবেচনার সুযোগ নেই। এটা হাট ইজারা কমিটির বিষয়। আবেদনটা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে, সরকার বিবেচনা করলে আমরা সেটা বাস্তবায়ন করবো। উনাদের ক্ষতি হচ্ছে সেটা তো আমরাও বুঝতে পারছি। তবে দেশ করোনামুক্ত হলে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত সব সেক্টরের পাশে দাঁড়াবে সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবৈধপথে এবার ভারতীয় গরু না আসায় বাজারে দেশি গরু দেখা যাচ্ছে। তবে করোনার কারণে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় অনেকে কোরবানি দিতে পারবেন না। সেই হিসাবে বাজারে ক্রেতা কম এবং গরুর দামও তুলনামূলক অনেক কম। ঈদের সামনে আরও কিছু দিন বাকি আছে। কিছু কেনাবেচা হয়তো বাড়বে।’