নড়াইলে এসএম সুলতানের ৯৬তম জন্মবার্ষিকী পালিত

শিল্পীর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৬তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে তাঁর জন্মস্থান নড়াইলে। জেলা প্রশাসন ও এসএম সুলতান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সোমবার (১০ আগস্ট) সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালায় আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচির।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ১০টায় কোরআন খানি, দোয়া মাহফিল, শিল্পীর মাজার জিয়ারত ও মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শিল্পীকে স্মরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা। অন্যদের মধ্যে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (জেনারেল) মো. ইয়ারুল ইসলাম, সুলতান আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ অনাদী বৈরাগী, এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি শেখ হানিফ, নড়াইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল ইসলাম টুলু প্রমুখ।

এসএম সুলতান এসএম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল শহরের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজমিস্ত্রি পিতা মেছের আলীর নান্দনিক সৃষ্টির ঘঁষামাজার মধ্য দিয়ে ছোট বেলায় লাল মিঞার (সুলতান) চিত্রাঙ্কনে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। অষ্টম শ্রেণিতে  থাকতে লাল মিঞা নড়াইলের তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের দৃষ্টিতে পড়েন। এ সময় তিনি সুলতানকে কলকাতায় নিয়ে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও শিল্প-সমালোচক কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য অধ্যাপক সায়েদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা বিচার না করেই ১৯৪১ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় অষ্টম শ্রেণী পাস সুলতানকে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৪ সালে কলেজের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে চতুর্থ বর্ষে উত্তীর্ণ হন তিনি। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেননি। কলেজ ছেড়ে কাশ্মীরের পাহাড়ী অঞ্চলে উপজাতীদের সঙ্গে বসবাস ও তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে চিত্রাঙ্কন শুরু করেন। 














নিজের আঁকা চিত্রকর্মের সঙ্গে পরে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে প্রখ্যাত চিত্রকরদের সঙ্গে তার ছবি প্রদর্শিত হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে শিল্পী মাটির টানে দেশে ফিরে আসেন এবং নিজস্ব উদ্যোগে জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় ফাইন আর্ট স্কুল ও ‘শিশুস্বর্গ’ নামে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিশু-কিশোরপ্রেমী সুলতান ১৯৮০ সালে নিজ বাড়িতে শুরু করেন শিশুস্বর্গের নির্মাণকাজ। ১৯৯২ সালে ৯ লাখ মতান্তরে ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থের ‘ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ’ নামে দ্বিতল নৌকা নির্মাণ করেছিলেন। এ নৌকায় তিনি শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে ভ্রমণ করতেন এবং নৌকায় বসেই তাদের চিত্রাঙ্কন শেখাতেন। তার শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু ছিল বাংলার কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার, মাঠ, নদী, হাওর, বাঁওড়, জঙ্গল, সবুজ প্রান্তর ইত্যাদি।

১৯৪৬-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পী সুলতানের ছবি ভারতের সিমলা, পাকিস্তানের লাহোর, করাচি, নিউইয়র্ক, বোস্টন, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন, এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ও জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকায় খ্যাতনামা বিভিন্ন চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রদর্শিত হয়।

বাঁশি হাতে শিল্পী বাঁশিও বাজাতে পারতেন এই শিল্পী। তাঁর হাতে প্রায়ই বাঁশি দেখা যেত। পুষতেন সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন পশু-পাখি। বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি মিনি চিড়িয়াখানা। সক্ষম হয়েছিলেন হিংস্র প্রাণিকে বশে আনতে।

১৯৮২ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক পান সুলতান। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট এবং ১৯৮৬ সালে চারুশিল্পী হিসেবেও স্বীকৃতি পান।

দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভোগার পর ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এই চিরকুমার, অসাম্প্রদায়িক শিল্পী যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নড়াইলের নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।  

মৃত্যুর পর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে শিল্পীর বাসভবন সংলগ্ন দুই একর ৫৭ শতক জমির ওপর নির্মিত হয় ‘এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’।