বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি ও অবৈধ বাণিজ্য ঠেকাতে গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্বশীলতা জরুরি

বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রজাতিসহ অনেক স্থলচর ও জলজ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব প্রাণী নিয়ে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এদের একটি বড় অংশ এখন বিলুপ্ত প্রায়। দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডাব্লিউসিএস) বাংলাদেশ, বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর একটি ডাটাবেস সংরক্ষণ করে আসছে। এই বেসরকারি সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদনকৃত ৬০৯টি বন্যপ্রাণীর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত ঘটনার মধ্যে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ক্ষেত্রেই বন্যপ্রাণীর প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে এসব প্রাণীকে ভুল নামে শনাক্ত করা হয়েছে।

শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সাংবাদিকদের নিয়ে দিনভর কর্মশালার সময়  সংস্থাটি জানায়, অনেক প্রতিবেদনেই জব্দকৃত প্রাণী বা দেহাংশের পরিমাণ, গ্রেফতারকৃত অপরাধীর সংখ্যা কিংবা পরবর্তী বিচারকাজ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। বিস্তারিত এসব তথ্য-উপাত্ত বন্যপ্রাণী ব্যবসা-বাণিজ্যের ধরণ ও গতিধারা সম্পর্কিত ধারণার পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের মাঝে বন্যপ্রাণী নিয়ে ব্যবসাদমনে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বন্যপ্রাণী নিয়ে ব্যবসায় এবং এ সংক্রান্ত অপরাধগুলো নিয়ে করা প্রতিবেদনের গুণগতমান উন্নয়নে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সঠিক ও সম্পূর্ণ প্রতিবেদন লেখার দক্ষতা বাড়াতে ডাব্লিউসিএস বাংলাদেশ ও বন অধিদপ্তর যৌথভাবে ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনার সিএসএস আভা সেন্টারে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালায় এ সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় ৩০টি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এই কর্মশালাটিতে অংশ নিয়েছেন।

কর্মশালার প্রধান অতিথি খুলনা জেলা ও দায়রা জজ মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ এবং এই অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে আমাদের সকলকে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে। অপরাধী সনাক্তকরণ ও তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হলে এবং এ বিষয়ক গণসচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে সহায়ক হবে। তাই সাংবাদিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের বন্য প্রাণীরা আমাদের দেশের সম্পদ এবং এদের টিকিয়ে রাখতে হলে দেশপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, তা নাহলে এদেরকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলবো।’

কর্মশালার প্রশিক্ষক ও ডাব্লিউসিএস বাংলাদেশের কান্টি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই কর্মশালাটি অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমকর্মীদেরকে বন্যপ্রাণীর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রতিবেদনসমূহের ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে সঠিক ও তথ্যবহুল প্রতিবেদন লেখার ও জনগণকে সচেতন করে তোলার মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধে সহায়ক ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দেবে।’

কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমকর্মীরা বিভিন্ন অনুশীলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিবেদনের ত্রুটি ও তথ্য অপ্রতুলতা চিহ্নিত করে সঠিক ও তথ্য বহুল প্রতিবেদন লেখা, নিয়মিতভাবে বাণিজ্যকৃত প্রাণীসমূহ শনাক্ত করার উপায় ও বিশ্বব্যাপী বিপন্ন বন্যপ্রাণীর ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিমালাসমূহ সম্পর্কেও জানতে পেরেছেন। অংশগ্রহণকারীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কর্মশালায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সকল স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়েছে।

অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘বন্যপ্রাণী ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা ও জনমত তৈরির মাধ্যমে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্যের বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরে গণমাধ্যম কর্মীরাও আমাদের এই প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।”

কর্মশালায় বলা হয়, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব বিলীনের জন্য দায়ী হুমকিসমূহ বিশেষ করে বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বন্যপ্রাণী ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য-উপাত্ত বিস্তারিত ও সঠিকভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরতে পারলে তা বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্যের ধরণ এবং গতিধারা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পেতে সাহায্য করবে। শুধু তাই ই নয়, এতে করে সরকারি কর্তৃপক্ষও বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধে উৎসাহী হবেন। ফলে বিশ্বব্যাপী বিপদাপন্ন অনেক বন্যপ্রাণী বাঘ, বনরুই,কচ্ছপ, হাঙর ও শাপলাপাতার বেশ কিছু প্রজাতিকে চিরতরে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।