বনজীবীদের দাবি সুন্দরবনে মরছে হরিণ, কর্মকর্তারা বলছেন গুজব

সুন্দরবনে আশঙ্কাজনক হারে মারা যাচ্ছে মায়াবী চিত্রল হরিণ। সুন্দরবন থেকে ফিরে এসে এমনটি জানিয়েছেন বনজীবীরা। অনুমতি নিয়ে মাছ, কাঁকড়া শিকার ও মধু সংগ্রহে গিয়ে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে মরা হরিণ ও হরিণের দেহাবশেষ দেখতে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন তারা।

বনজীবীরা জানান, কোনও কোনও স্থানে শুধু হরিণের হাড়গোড় ও মাথা পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। আবার কোথাও কোথাও সদ্য মরা হরিণও দেখা গেছে। এমনকি বিভিন্ন স্থানে জীবিত হরিণগুলোকে অসুস্থ ও কঙ্কালসার অবস্থায় দেখেছেন বলেও দাবি করেছেন বনজীবীরা।

তবে বন বিভাগ বলছে অন্য কথা। তারা বলছে, এমন সংবাদ শোনার পর সম্প্রতি তারা সুন্দরবনে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু এর পক্ষে কোনও প্রমাণ যাওয়া যায়নি। সুন্দরবনে বন বিভাগ এখন যেকোনও বিষয়ে আগের চেয়ে তৎপর। এ কারণে কিছু বনজীবী গুজব ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসীন হোসেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধান চালানো সহজ হবে বলে মন্তব্য করেছে বন বিভাগ।

লবণাক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি লতাপাতা পড়ে বিষাক্ত হওয়া আবদ্ধ পানি খেয়ে হরিণগুলো মারা যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বনজীবীরা। তবে খাদ্য সংকটে অসুস্থ হরিণগুলো মশা ও ডাসকাটাশির তীব্র আক্রমণের শিকার হচ্ছে বলেও জানান এসব বনজীবী।

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনীসহ কয়রা উপজেলার বনজীবীরা জানান, সুন্দরবনে হরিণ মারা যাওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা মিলেছে। হরিণ মারা যাওয়ার ঘটনা খুলনা রেঞ্জে বেশি হলেও সাতক্ষীরা রেঞ্জের কয়েকটি স্থানেও তারা মৃত হরিণ দেখেছেন।

গভীরে বনে মধু সংগ্রহ

বনজীবীরা জানান, পাতকোষ্টা, কাগারঝেলে, হংসরাজসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে তারা বেশিরভাগ মৃত হরিণ দেখতে পেয়েছেন। এপ্রিল মাসের শুরু থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের পর তারা এমনটা দেখছেন বলেও দাবি করেন।

গাবুরার মৌয়াল জিন্নাত আলী জানান, নয় জন মিলে গভীর সুন্দরবনে যাওয়ার পর পাতকোষ্টা এলাকায় তাড়কেল (গুইসাপ) ও শূকর মিলে একটি হরিণকে তারা খেতে দেখেছে। পরে আরও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সদ্যমৃত আরও একটি হরিণ দেখতে পায় তারা। তার সহযোগী মৌয়াল মুসা, বিল্লাল হোসেন ও আল আমিন প্রমুখ হরিণ মরার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, তারা ১৫ দিন সুন্দরবনে ছিলেন। এ সময় ১১টি মৃত হরিণ তারা দেখেছেন।

শ্যামনগর উপজেলার সোরা গ্রামের তাইজুল ইসলাম ও আজিজুর রহমান এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে দ্বিতীয় মেয়াদের পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে মধু সংগ্রহ করতে সুন্দরবনে যান। ছাটা দিয়ে যাওয়ার সময়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের শেষ প্রান্তে গেওয়াখালীতে স্বল্প দূরত্বে আটটি মরা হরিণ দেখেন তারা। এছাড়া পাতকোষ্টা আর হংসরাজ এলাকায়ও একাধিক মৃত হরিণ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এ দুই বনজীবী।

কাঁকড়া শিকারের পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়া সোরা গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে মোফাজ্জল হোসেনও জানান একই কথা। বলেন, কাগা দোবেকী এলাকায় তিনিও একটি মৃত হরিণ দেখেছেন। হরিণটি কংকালসার ছিল। শূকর বা অন্য কিছুতে না খাওয়ায় চামড়া শুকিয়ে শরীরে লেপ্টে ছিল।

৫৩ বছরেও এভাবে হরিণ মরার দৃশ্য দেখেননি কয়রা উপজেলার ৪নং কয়রা গ্রামের হযরত আলী সানা। জানান, হরিণের এভাবে মৃত্যু স্বাভাবিক না। বাঘে খেলে এভাবে হরিণ পড়ে থাকার কথা না। পানির সমস্যার কারণে হরিণ দেদার মরছে বলে জানান তিনি।

বন থেকে ফিরে মৌয়াল ফারুক হোসেন বলেন, আমরা ছয় জন একত্রে বাড়ি ফিরেছি। শিবসা, বাটুলিয়া, চামটা, সোনামুগুর ও আন্ধার মানিক এলাকায় মৌচাক কাটার সময় আমরা অন্তত ২০টি মৃত হরিণ দেখেছি।

আরও অনেক বনজীবী হরিণ মারা যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন। তাদের দাবি, সুন্দরবন এলাকার পানি মারাত্মক লবণাক্ত হয়ে গেছে। আবার অনাবৃষ্টির কারণে আবদ্ধ জায়গার পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। এসব বিষাক্ত পানি খেয়ে হরিণ দেদার মরছে বলে তাদের ধারণা।

বনজীবী হযরত আলী সানা জানান, আগে শিবসা ও পশুর নদীর পানিতে ভাত রান্না করে খেয়েছেন। কিন্তু এ বছর সেই পানিতে তারা গোসল পর্যন্ত করতে পারেনি। এই পানি শরীরে লাগলে তীব্র জ্বালা হয় তথ্য দিয়ে বনজীবী তাইজুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি খালের পাশে হরিণ মরে থাকতে দেখা গেছে। বিষাক্ত পানি খেয়ে হরিণগুলো মারা পড়েছে। আর জীবিত হরিণগুলো খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল।

মৌচাক

এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ভেটেরিনারি সার্জন জহিরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বন বিভাগের। প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দরবনের জীব-জানোয়ার নিজেদের টিকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। তবে নির্দিষ্ট ল্যাবে মৃত হরিণ পরীক্ষা করলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। পরীক্ষা ছাড়া কারণ বলা যাবে না। তবে বছরের এ সময় গাছ ও ঘাসে যে নতুন ডাল/পাতা বের হয় সেগুলো নাইট্রেট পয়জনিং হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে প্রাণিবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, বনজীবীদের কাছে হরিণ মরার খবর শুনেছি। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ-খবর নিয়েছি। নির্ভরযোগ্য কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি দ্রুত তদন্ত করা দরকার। আন্তবিভাগীয় বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে এর কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। কী কারণে মরছে? অতি লবণাক্ততা, নাকি খাবার কমে গেছে। নাকি নতুন কোনও রোগের কারণে এটা হচ্ছে। এটা তদন্ত করতে হবে বন বিভাগকে।

খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসীন হোসেন জানান, এ সংবাদ শুনে বনকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছে, কিন্তু সত্যতা পায়নি। এটি গুজব। এটি এক মাস ধরে ছিল। যেসব এলাকার কথা বলেছে সেখানে গিয়ে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি বাঘের জন্য সাত দিনে একটি করে হরিণ প্রয়োজন হয়। শতাধিক বাঘের এ সুন্দরবনে অনেক হরিণ বাঘের খাবার হিসেবে চলে যায়। এসব হরিণের হাড়, মাথা কিংবা কংকাল দেখে বনজীবীরা ভুল ধারণা পেতে পারেন। তিনি আরও বলেন, হরিণ মারা, বিষ দিয়ে মাছ ধরাসহ বিভিন্ন অপকর্ম বন বিভাগের তৎপরতায় বন্ধ হয়েছে। সে কারণে বন বিভাগের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে তারা। সুন্দরবনের যত্রতত্র হরিণ পড়ে থাকার কথা নয়। হরিণ মারা গেলে তা গুইসাপের খেয়ে ফেলার কথা। তবে কেউ নির্দিষ্ট করে মরা হরিণের সন্ধান দিতে মৃত্যুর কারণ জানা সম্ভব হবে।