স্বামী অসুস্থ, ছেলে বন্দি, হাল ধরেছেন ফিরোজা

সচরাচর নারীদের মাঝি হিসেবে খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রমজাননগর ইউনিয়নের ধজিখালী নদীতে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। সুন্দরবনের দ্বীপ গ্রাম গোলাখালি। গ্রামের একপাশ সুন্দরবনের সঙ্গে লাগোয়া, বাকি তিন পাশে নদী। গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজা বিবি। চার বছর ধরে খেয়া পারাপার করেন। স্বামী অসুস্থ, ছেলে ভারতের জেলে বন্দি। স্বামী মতিয়ার গাজী, পুত্রবধূ ও দুই নাতনি নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার। খেয়া পারাপার করে চলে ৪৭ বছর বয়সী এই নারীর সংসার।

ফিরোজা বিবি বলেন, ‘কি করমু। আমাগির এলাকায় দিনদিন কাজ কমি যাতিছে। অধিকাংশ মানুষ নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরে। কিন্তু নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। সুন্দরবনে আগের মতো যাতি দেয় না। সরকারি পাঁচ বাহিনী কাজ করে। চার বছর ধরি খেয়া পারাপার করতিস। স্বামী অসুস্থ। কাজ করতে পারে না। প্রতিবছর তার পেছনে অনেক টাকা খরচ করতি হয়। তার হার্টের সমস্যা। বাধ্য হুয়ি হাতে বইঠা নিতে হুয়িছে।’

তিনি বলেন, ‘দিনে মানুষ একশোর বেশি বার সুন্দরবন সংলগ্ন ধজিখালি নদীর এপার-ওপার যাবা-আসা করতি হয়। এতে চলে পাঁচ সদস্যের সংসার। ছেলে ভারতের জেলখানায় আটকায় আছে। ছেলের বউ নদীতে জাল টানে মাছ ধরে। জোয়ার আসে, ভাটা আসে। আসে তুফান। পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে খুব কষ্ট হয়। নদীতে নৌকা এবং ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযান চলে। তবে সবাই আমাকে সাহায্য করে।’

চার বছর ধরে খেয়া পারাপার করেন ফিরোজা বেগম

ফিরোজা বিবি আরও বলেন, ‘এই এলাকার মানুষের যে কী কষ্ট। তা কেউ না দেখলি বুঝতি পারবে না। এই এলাকা দুর্গম হওয়ায় এখানে কেউ আসতি চায় না। সে জন্নি আমাগির খোঁজ নোবার কেউ নেই। প্রতিবছর আমাগির এলাকা ডুবি ঘর বাড়ি নদীতে নিয়া যায়। নদীর চরে ঘরবান্দি কোনও রকম থাকি। গত বছর ৩০ কেজি চালের কার্ড পায়িলাম। সেই কার্ড থাকি দুবার চাল তুলিছি। বিপদ-আপদ হলে খোকন ভাই (স্থানীয় সমাজসেবক) দেখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকের ঘর দেছে। আমার যদি একটি ঘর দিতু তাহলে প্রধানমন্ত্রীর জন্নি সারাজীবন দোয়া করতাম।’

ফিরোজা বিবি জানান, গোলাখালি এবং কুলোপাড়ার লোকজনকে মাসিক চুক্তিতে পারাপার করেন। মাসে ১৫০ টাকা করে দেয়। এতে নয় পরিবার থেকে মাসে ১৩৫০ টাকা আয় হয়। নৌকার পেছনে কিছু টাকা খরচ হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে কোনও রকম দিন কেটে যায়। তবে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়।’ 

স্থানীয় সমাজসেবক কামাল হোসেন খোকন বলেন, আমরা কত কষ্ট করে বসবাস করি তা বলে বোঝাতে পারবো না। তিন পাশে নদী ও একপাশে সুন্দরবন। নৌকা ছাড়া গ্রামে আসার উপায় নেই। ভেটখালি থেকে ট্রলারে আসতে সময় লাগে একঘণ্টা। কেউ মারা গেলে ভেটখালি নিয়ে কবর দেওয়া লাগে।

খেয়া পারাপার করে চলে ৪৭ বছর বয়সী এই নারীর সংসার

রমজানগর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ ওয়ার্ডের সদস্য গাজী সোহরাব হোসেন বলেন, ফিরোজা বিবি নারী হয়েও অনেক কষ্ট করে খেয়া পারাপার করেন। আমার কাছে কোনও সহায়তা এলে তাকে দেওয়ার চেষ্টা করি। 

রমজাননগর ইউপি চেয়ারম্যান আল মামুন বলেন, কালিঞ্চি ও ধজিখালি গোলাখালি ঘাট সংস্কারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ. ন. ম আবুজার গিফারী বলেন, ফিরোজা নামে একজন নারী খেয়া পারাপার করেন। এই অঞ্চলের মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্য ঘাটটি নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। খাস জমি পাওয়া সাপেক্ষে ফিরোজা বিবির জন্য মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাকা ঘর দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।

শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন বলেন, নারী হয়েও খেয়া পারাপার করছেন তিনি। আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সাহায্য করবো। দ্রুত খেয়াঘাট সংস্কারের ব্যবস্থা করবো। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘরের বাজেট এলে তাকে ঘর দেওয়ার চেষ্টা করবো।