লোনা পানি পান করছেন সাতক্ষীরার ৫ লাখ মানুষ

২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা’র পর থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলজুড়ে নিরাপদ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিগত কয়েক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সাতক্ষীরা উপকূলের পাঁচ লাখের বেশি মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। চলতি খরা মৌসুমে এই সংকট তীব্র হয়েছে। 

গ্রামের মানুষদের এখন কলসি নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের কমপক্ষে ৪০ লাখ মানুষ পুকুরের পানি ও নদীর লোনা পানি খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (২২ মার্চ) এসব তথ্য দিয়েছেন সাতক্ষীরার কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা। 

তারা জানান, সরকারি হিসাব অনুযায়ী খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ। পানি সংকট নিরসনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে উপকূলজুড়ে খাবার পানির জন্য পুকুর খনন, টিউবওয়েল স্থাপন, পন্ডস অ্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতেও সংকট দূর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা। 

সাতক্ষীরার ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮১ মানুষের মধ্যে উপকূলের সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পাঁচ লক্ষাধিক। গ্রামের নারীরা কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করেন।

উপকূলের মুন্সীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে আমাদের এলাকায় পানি সংকট ছিল না। ২০০৯ সালের পর থেকে পানিতে লবণাক্ততা বেশি দেখা দিয়েছে। সুপেয় পানির সংকটও তীব্র হয়েছে। এই মৌসুমে পানি সংকট আরও প্রকট হবে।

শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালী ইউনিয়নের দাতিনাখালী এলাকার শেফালী বেগম বলেন, আমাদের এলাকায় খাওয়ার পানির খুবই সমস্যা। দুই-তিন কিলোমিটার দূরে কলসি নিয়ে পানি আনতে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে আবার লাইনে দাঁড়াতে হয়। খাবার পানি সংগ্রহ করতে দিনের তিন-চার ঘণ্টা চলে যায়। খরা মৌসুমে আমাদের এলাকায় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। ২০০৯ সালের পর থেকে পানি সংকট সমস্যার সমাধান হলো না। পানির জন্য এই কষ্ট কবে যে দূর হবে কে জানে!

সুপেয় পানির সংকটে সাতক্ষীরার ৫ লক্ষাধিক মানুষ

আটুলিয়া ইউনিয়ন হাওয়ালভাঙ্গি গ্রামের ‘পানি আপা’ নামে পরিচিত শেফালী খাতুন বলেন, যেসব বাড়িতে পানির ফিল্টার আছে, সেগুলো পরিষ্কার করেন তিনি। এছাড়া কীভাবে ফিল্টার পরিষ্কার করতে হয় তা অন্যদের শিখিয়ে দেন। সবার কাছ থেকে ফিল্টার মেরামত বাবদ ২০ টাকা করে নেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্স’র নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন, খাবার পানির সংকট নিরসনে আরও প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার। বিশেষ করে পুকুর খনন, পিএসএফ স্থাপন, টিউবওয়েল স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের আরও বড় বড় প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। গভীর নলকূপ ও পানির বড় ট্যাংকের ব্যবস্থা আছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সরকারি এবং বেসরকারি পানির ট্যাংক প্রদান করা হয়েছে। যেসব এলাকার গভীর নলকূপ থেকে লোনা পানি ওঠে, সেসব এলাকায় পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলে প্রতিবছর ঘূণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে লোকালয়ে লবণ পানি প্রবেশ করছে এবং খাবার পানির আধারগুলো নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া সাতক্ষীরা উপকূলের সব স্থানে গভীর নলকূপ সাকসেস হয় না। 

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে। যেসব এলাকায় গভীর নলকূপ থেকে লোনা পানি ওঠে, সেখানে পুকুর কেটে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব দ্রুত এই অঞ্চলের পানি সমস্যার সমাধান হবে।

জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আ. বাছেদ জানান, সাতক্ষীরা সমুদ্র উপকূলীয় জেলা হওয়ায় প্রতিবছর বিভিন্ন দুযোর্গের মুখোমুখি হচ্ছে। সুপেয় পানি লবণাক্ততা দিন দিন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে কাজ করছে।