চুয়াডাঙ্গার চুল যাচ্ছে চীনে, ফিরছে হাজারো মানুষের ভাগ্য

নারীরা চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ানোর পর উঠে আসা চুল ফেলে দেন। অনেকে আবার জমিয়ে রাখেন। জমানো চুল দিয়ে ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে বাদাম, পাপড়, আইসক্রিম ও বেলুনসহ অন্যান্য জিনিস নেন। সংগ্রহ করা চুল কারখানায় চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন ফেরিওয়ালারা। এসব চুল প্রক্রিয়াজাতের কাজ করে বদলে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার হাজারো মানুষের জীবন।

জানা গেছে, সীমান্তবর্তী এই জেলায় শতাধিক চুলের কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানাকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো নারী-পুরুষের। বদলে গেছে এলাকার অনেক তরুণের ভাগ্য।

ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কেনা চুল কারখানার কর্মীরা বাছাই করেন। পরে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন দিয়ে আকারভেদে পৃথক করা হয়। এরপর রাবার ও সুতা দিয়ে বাঁধেন কর্মীরা। এভাবে প্রক্রিয়াজাত শেষে কার্টনে রাখা হয়। এই কাজ করে প্রতি মাসে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পান কর্মীরা। অন্যদিকে, কারখানায় কর্মরত কারিগররা দক্ষতা অনুযায়ী ৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পেয়ে থাকেন। প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার চুল এখান থেকে চীনে যাচ্ছে।

চুলের কারখানাকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারও নারী-পুরুষের

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কুতুবপুর গ্রামের কয়েকজনের মাধ্যমে এক দশক আগে পরিত্যক্ত চুলের ব্যবসার যাত্রা শুরু। তবে শুরুটা কয়েকজনের মাধ্যমে হলেও এখন ব্যবসায়ীর সংখ্যা কয়েকশ’। প্রথমদিকে প্রক্রিয়াজাত ছাড়াই অবৈধভাবে ভারত ও মিয়ানমারে চুল পাচার করা হতো। ব্যবসাটি বেশ লাভজনক হওয়ায় সবার চাওয়া ছিল সরকারিভাবে বৈধতা পাওয়ার। পরে সরকারি কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলে ব্যবসাটি বৈধতা পায়। ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ শুরু করেন চীনের চুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। চীনা ব্যবসায়ীরা এই দেশে এসে মানসম্মত চুল দেখে কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে।

ব্যবসাটি লাভজনক হওয়ায় ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটেছে পুরো চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায়। এসব এলাকায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন চুলের কারখানা। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে ঝুকছেন এ ব্যবসায়। যুক্ত হচ্ছেন এলাকার শিক্ষিত বেকাররাও। চুল ব্যবসায়ীদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ‘একতা হেয়ার প্রসেসিং সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামের একটি সংগঠনও।

ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কেনা চুল কারখানার কর্মীরা বাছাই করেন

চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবসায়ী ছাত্তার আলী জানান, প্রথমে লোহার কাটা বা কাঁচি দিয়ে জড়ানো চুলগুলো ছাড়িয়ে লম্বা করে গোছা করা হয়। এরপর গোছাগুলো শ্যাম্পু দিয়ে একাধিকবার ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকানোর পর বাছাই করে তুলি দিয়ে বেঁধে ছোট-বড় আলাদা করে প্যাকেটজাত করে আনা হয় ঢাকায়। সর্বনিম্ন ৮ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা চুল বিক্রি হয়। ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত প্রতি কেজি চুল বিক্রি হয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায়। বিদেশে এসব চুল ক্যাপ তৈরি ও টাক মাথায় চুল প্রতিস্থাপনসহ আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।

কার্পাসডাঙ্গা চুল সমিতির সভাপতি শহীদ বিশ্বাস জানান, বর্তমানে এক কেজি লম্বা চুলের দাম ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। একজন চুল ব্যবসায়ী প্রতি মাসে আয় করেন এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন অন্তত তিন হাজার কেজি চুল আমদানি হয় চুয়াডাঙ্গায়, যা প্রতিদিন বিক্রি হয় কোটি টাকার ওপরে।

চুল প্রক্রিয়াজাতের কাজ করে বদলে যাচ্ছে হাজারও মানুষের জীবন

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘পরিত্যাক্ত চুল প্রক্রিয়াজাত ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এই পেশায় নারীরা বেশি যুক্ত হচ্ছেন। জেলা প্রশাসন তাদের সবরকম সহযোগিতা করবে। ইতোমধ্যে সমাজসেবা ও যুব উন্নয়ন এসব ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করছে।