জোয়ারে প্লাবিত ২ কোটি টাকার গুচ্ছগ্রাম

খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের চরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত গুচ্ছগ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। শেওড়া গ্রামের এই ‌‘গুচ্ছগ্রাম’ জোয়ার এলেই ডুবে যায়। যাতায়াতের সুব্যবস্থা নেই, নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। ইতোমধ্যে ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার। 

স্থানীয় জাকা‌রিয়া হোসেন বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের চরে গড়ে ওঠা এই গুচ্ছ গ্রামে ৬০টি বসতঘর ও সুন্দর একটি অফিস কক্ষ রয়েছে। চারটি অগভীর নলকূপই নষ্ট। বৈদ্যুতিক পিলার ও তার থাকলেও নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। নদীর পানি রক্ষায় তিন পাশে বাঁধ রয়েছে। বাঁধের উত্তর ও পশ্চিম পাশের ভাঙন দিয়ে ভেতরে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে গুচ্ছগ্রামের তিনটি পুকুর, চলাচলের রাস্তা ও আঙিনা। তেমন বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি এলেই তলিয়ে যায়।’ 

গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দিা জামিলা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘদিন জোয়ারের পানি ওঠানামা করায় মাঠের বালু ধুয়ে নদীতে চলে যাচ্ছে। চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি জোয়ারে ঘরের আঙিনায়, এমনকি মেঝেতে পানি ওঠে।’

গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া রঞ্জিতা দাস বলেন, ‘গুচ্ছগ্রামের রাস্তা বাদেও প্রধান সড়ক ভালো না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় কেউ ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ালেখা করে, আবার কেউ সোলারের আলোতে পড়াশোনা করে।’

বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি এলেই তলিয়ে যায় গুচ্ছগ্রাম

গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে যাওয়া শাহজাহান মোড়ল বলেন, ‘আশ্রয় পেয়ে খুশি মনে এখানে এসেছিলাম। তবে থাকার পরিবেশ না থাকায় চলে গেছি। যেখানে এখন রয়েছি সেখানেও খুব কষ্টে ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি।’

গুচ্ছগ্রাম উপকারভোগীদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বসবাসের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬০টি ঘরের ব্যবস্থা করায় আমরা খুব খুশি। তবে কিছু সমস্যায় আমাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। নদীর পানি রক্ষায় মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও ঘরের মেঝেগুলো পাঁকার ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তিতে বসবাস করতে পারতাম। এছাড়া সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ও পুকুরের পাড় বাধার ব্যবস্থা করতে পারলে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারতাম।’

কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ৬০টি ঘর নির্মাণের জন্য ৯০ লাখ, চারটি নলকূপ স্থাপনের জন্য তিন লাখ ২০ হাজার, কমিউনিটি ভবন তৈরির জন্য সাত লাখ ৯৩ হাজার টাকা এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের জায়গা ভরাটের জন্য ২৫১.৪০১ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে তৎকালীন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (বর্তমানে মোংলায় কর্মরত) জাফর রানা বলেন, ‘নদীর তীরে পাইলিংয়ের মাধ্যমে বাঁধের ব্যবস্থা করতে পারলে জোয়ারের পানি আসতো না। তবে পাইলিংয়ের বরাদ্দ না পাওয়ায় আমরা কাজ করতে পারিনি। পুকুর সংরক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ইচ্ছা থাকার পরও অন্যত্র চলে আসায় সেটার ব্যবস্থা করতে পারিনি।’

বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ গাজী বলেন, ‘ওখানে ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের একটি বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি এক মাস থেকে দেড় মাসের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর কোনও অতিরিক্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় না। তিন বার আবেদন করার পর বলা হয়েছে, নতুন কোনও বরাদ্দ দেওয়া হবে না। এজন্য আমাদের স্থানীয়ভাবে টিআর/কাবিখা থেকে সংস্কার কাজ করতে হয়, যা দিয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণ অসম্ভব। এছাড়া গুচ্ছগ্রামগুলো বেড়িবাঁধের বাইরে হওয়ায় নিরাপদ না। একবার বাঁধ সংস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, নদীর তীর হওয়ায় ফের ভেঙে গেছে।’

উল্লেখ্য, উপজেলায় ছয়টি গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। নদীর চরে স্থাপিত হওয়ায় একটু ঝড়-বৃষ্টিতে অধিকাংশ স্থানেই ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয় বসবাসকারীদের।

এদিকে ডুমুরিয়া উপজেলায় ভদ্রা নদীর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে ভান্ডারপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নিম্নাঞ্চল। এতে শিক্ষার্থীরা চরম দূর্ভোগে পড়েছে। গত দুই দিন বিদ্যালয়ের মাঠে জোয়ার-ভাটা বইছে। ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে জোয়ারের সময় নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়। এতে ভান্ডারপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্লাবিত হয়। হুমকীর মধ্যে রয়েছে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩৫১টি ঘর।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুনীল কুমার মন্ডল জানান, নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি হওয়ায় বাঁধ তলিয়ে বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। দ্রুত বাঁধের উন্নয়ন না করা হলে পাঠদানের বিঘ্নসহ ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মাহাবুর রহমান শেখ জানান, ভদ্রা নদীর রক্ষাবাঁধ অত্যান্ত দুর্বল। যে কারণে নদীতে পানি বেশি হলেই বাঁধ উপচে ভেতরে ঢোকে।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরীফ আসিফ রহমান বলেন, ‘বাঁধ মেরামতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’