খুলনা অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট

এক কলসি পানির জন্য হাঁটতে হয় দুই কিলোমিটার

খুলনা অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট কমছেই না। উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার চলছে। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও পরিবারের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহে পাড়ি দিচ্ছে মাইলের পর মাইল। অনেকে বাধ্য হয়ে পান করছেন পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানি। এমন পরিস্থিতিতে মুজিববর্ষে দেওয়া গৃহে বসবাসরতদের জন্য পৃথক পানির উৎস সৃষ্টি নিয়েও ভাবছে প্রশাসন।

প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির আধার নষ্ট হওয়া, গভীর নলকূপের পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে মিলছে না নিরাপদ পানি। দীর্ঘদিনের এ সমস্যায় উপকূলীয় জনপদের দৈনন্দিন জীবনে পড়ছে প্রভাব।

চৈত্র বৈশাখ মাসে এ অঞ্চলের পুকুর-নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। ফলে খাবার পানির জন্য মানুষকে আরও বেশি কষ্ট পেতে হয়। খাবার পানির উৎস পাওয়া কঠিন হয়। দুই-একটি উৎস পেলেও তা বেশ দূরে। ফলে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে কষ্ট করতে হয়। আর মিষ্টি পানির পুকুর থাকলেও তা জলোচ্ছ্বাস, প্রকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পুকুরের পানিও পানযোগ্য থাকে না। মানুষ বাধ্য হয়ে ওই পানিই পান করে। ফলে পানিবাহিত রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।

কয়রা সদরের হালিমা বেগম বলেন, ‘লবণাক্ততার কারণে খাবার পানির জন্য বেশ চিন্তায় থাকতে হয়। হেঁটে দুই কিলোমিটার দূর থেকে এক কলসি পানি আনতে হয়। আমাদের কষ্টের যেন শেষ নেই।’ 

পাইকগাছা সদরের শিলা রানি বলেন, ‘পাশের পুকুরের পানিই ভরসা। ওই পানি এনে কলসে রেখে পান করতে হয়।’

উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুকুরের পানি ফিল্টারিং করে ব্যবহার করছেন মানুষজন। তবে অধিকাংশ পিএসএফ (পন্ড স্যান্ড ফিল্টার) অকেজো হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছেন উপকূলবাসী। 

খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকমল হোসেন বলেন, ‘যেহেতু খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চল। এখানে লবণাক্ততার প্রভাব বেশি। এ লবণাক্ততা সহজে রিমুভও করা যায় না। আর যে প্রসেস আছে সেটা হলো রিভার অসমোসিস (পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া)। এটা আবার পরিবেশবান্ধব না। তাই এ প্রসেসটাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি। আমরা জোর দিচ্ছি ভূ-উপরিস্ত পানি ও প্রকৃতিক উৎস বৃষ্টির পানিতে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রয়েছে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও খাল-পুকুরের পানি পরিশোধন করে পানযোগ্য করার। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আর নিয়মিত কাজ গভীর ও অগভীর নলকূপ নিয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের পর থেকে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে উপকূলবাসী কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। 

পানি সমস্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এওসেডের সমন্বয়কারী (কর্মসূচি) মাহাবুবুর রহমান মোহন বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার বন্ধে সরকারের উদ্যোগ জরুরি। পাশাপাশি উপকূলের পানি সমস্যা মোকাবিলায়ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। শুধু প্রকল্প গ্রহণেই সমাধান হচ্ছে না, মনিটরিং প্রয়োজন ‘

প্রকল্প দিয়েও পানি সংকট সমাধান করা সম্ভব নয় বলে দাবি করছেন তৃতীয় উপকূলীয় পানি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব ও এওসেড নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফিন।

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসীর আরেফীন বলেন, ‘মুজিব বর্ষে অসহায় ও ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার পাশাপাশি সুপেয় পানির বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে চার-পাঁচটি পরিবারের জন্য একটি করে নলকূপ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। আর কয়রা ও পাইকগাছার দুর্গম এলাকায় পিএসএফ সিস্টেমসহ বিকল্প নিয়ে চিন্তা চলছে।’