সুন্দরবনের ‘খাঁটি মধু’ নামে ‘ভেজাল মধু’তে সয়লাব খুলনা

সুন্দরবনের খাঁটি মধুর আড়ালে ভেজাল মধুতে সয়লাব হয়ে গেছে খুলনা। পুলিশের গত দুই দিনের পৃথক অভিযানে ৭শ লিটার ভেজাল মধু জব্দ করা হয়েছে। এ সময় আটক করা হয়েছে ৩ জনকে। এদের মধ্যে একজনকে ১০ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

কেএমপির বিশেষ পুলিশ সুপার (সিটিএসবি) রাশিদা বেগম জানান, মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) খালিশপুরে ‘খুলনা মধু ঘর’ কারখানায় অভিযান চালিয়েছে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যরা। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির মালিক স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন আব্দুল্লাহ আল মামুনকে (২৭) ১০ দিনের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জব্দ করা হয় ৬শ লিটার ভেজাল মধু।

কেএমপির প্রেস বার্তায় জানানো হয়, খুলনা মহানগর ডিবি পুলিশের একটি টিম খালিশপুর থানাধীন উত্তর কাশিপুর এলাকায় একটি কারখানায় ভেজাল মধু মোড়কজাত ও বাজারজাত করা হচ্ছে বলে সংবাদ পায়। এর প্রেক্ষিতে তারা মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় খালিশপুর থানাধীন উত্তর কাশিপুর কবরখানা রোডস্থ হোল্ডিং নং-০৪/১১ খোকা মিয়ার চারতলা বিশিষ্ট বাড়ির নিচতলার গ্যারেজে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মধু জব্দ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ২২টি জারিকেনে ৫৮২ লিটার, ১৮টি প্লাস্টিকের এক লিটারের বোতলে রক্ষিত ১৮ লিটার মিলিয়ে মোট ৬০০ লিটার কথিত মধু।

জানা যায়, ‘খুলনা মধু ঘর’ নামক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী খালিশপুর থানাধীন কাশিপুরের বাইতিপাড়ার পোড়াবাড়ি মসজিদ কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা এনাম হোসেনের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স ব্যতীত বিএসটিআই’র মানচিহ্ন ব্যবহার করে কথিত মধু (ভেজাল মধু) মোড়কজাত ও বাজারজাত করে আসছিলেন। মামুন স্থানীয় জোড়াবাড়ী মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি ভেজাল মধু মোড়কজাত ও বাজারজাত করেন। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, খুলনা এবং বিএসটিআই, খুলনার প্রতিনিধি সমন্বয়ে টিম তাকে অননুমোদিত বিএসটিআই মানচিহ্ন ব্যবহারের জন্য বিএসটিআই আইন-২০১৮, ধারা-১৫(১) এর ২৭ মূলে ২৫,০০০ টাকা জরিমানা এবং ১০ (দশ) দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়। জব্দকৃত মধুর গুণগত মান পরীক্ষার জন্য বিএসটিআই’র ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ডিবি) বিএম নুরুজ্জামান সোমবার বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, কেএমপি’র গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ অভিযানে গত ১১ সেপ্টেম্বর ১০৫ কেজি ভেজাল মধু এবং ভেজাল মধু তৈরির সরঞ্জামসহ দুই জনকে আটক করা হয়। এদিন দুপুর পৌনে ৩টার দিকে মহানগর ডিবি পুলিশের একটি টিম আড়ংঘাটা থানাধীন সিটি বাইপাস সড়কের আকমানের মোড়স্থ এলাকায় একটি কারখানায় নকল ও কথিত মধু (ভেজাল মধু) উৎপাদিত হচ্ছে বলে সংবাদ পায়। এর প্রেক্ষিতে আড়ংঘাটা থানাধীন সিটি বাইপাস সড়কের আকমানের মোড়স্থ বাইতুশ শরিফ জামে মসজিদের পূর্ব পাশে অপুর টিনশেড বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মাথুরাপুর গ্রামের আব্দুর রশীদের ছেলে মো. আশরাফুল ইসলাম রিপন (৩৪) ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ শাহরিয়ার মাসুদকে (৩৮) কথিত মধু (ভেজাল মধু) এবং তৈরির সরঞ্জামসহ আটক করা হয়।

অভিযানকালে ১০৫ কেজি (ভেজাল মধু); একটি হলুদ রংয়ের প্লাস্টিকের তৈরি ড্রামে রক্ষিত চিনি সিরা, ওজন ১০ কেজি; ফ্রেশ দুই লিটারের পানির বোতলে রক্ষিত জ্বালানো মধু, যা রং হিসেবে মধু তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, ওজন দুই কেজি, সাদা প্লাস্টিকের কৌটায় রক্ষিত ফিটকিরি গুঁড়া, ওজন ২০০ গ্রাম; একটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তায় রক্ষিত চিনি, ওজন ১২ কেজি; একটি প্লাস্টিকের পানির জার যার গায়ে রং দিয়ে এমডি লেখা; একটি নীল রংয়ের প্লাস্টিকের অর্ধেক ড্রাম, যা মধু রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়; একটি এক বার্নার বিশিষ্ট গ্যাসের চুলা, যার গায়ে ওমেরা লেখা; একটি বেক্সিমকো ব্র্যান্ডের গ্যাস সিলিন্ডার; একটি মেঘনা ডিজিটাল পরিমাপক যন্ত্র; প্লাস্টিকের তৈরি নীল কর্কযুক্ত সাদা রংয়ের বোতল ১৪টি; কাচের তৈরি বোয়াম ১২টি; সাদা রংয়ের প্লাস্টিকের তৈরি ছোট কৌটা ২৪টি; সাদা কর্কযুক্ত প্লাস্টিকের ছোট বোতল ৩৬টি; সবুজ রংয়ের প্লাস্টিকের তৈরি কর্ক (মধু ঢালার পাত্র) একটি এবং কালো জিরা ফুলের মধু লেখা পাঁচটি স্টিকার জব্দ করা হয়।

জানা যায়, ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ভেজাল মধু তৈরির জন্য প্রথমে চিনি, ফিটকিরি, কেমিক্যাল গ্লুকোজ ও অন্যান্য সরঞ্জাম চুলায় ফুটিয়ে নেয়। তারপর মিশ্রণ ঠান্ডা হলে মধুর ফ্লেভার আনার জন্য তাতে সামান্য পরিমাণ মধু মেশানো হয়। এরপর সেই মিশ্রণ বোতলজাত করে তার গায়ে ‘অর্গানিক বিডি’র লেবেল লাগিয়ে বাজারজাত করা হয়। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় সুন্দরবনের কথিত খাঁটি মধু।

গ্রেফতারকৃত মো. আশরাফুল ইসলাম রিপনের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা এবং শেখ শাহরিয়ার মাসুদের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে আড়ংঘাটা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে।