আইন লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো

খুলনা মহানগরীতে আইনের তোয়াক্কা না করে চলছে তামাক পণ্যের প্রচারণা। সিগারেট কোম্পানিগুলো ক্রেতা-বিক্রেতাসহ ধূমপানকারীদের রঙছটা বিজ্ঞাপন আর পুরস্কার প্রণোদনায় আকৃষ্ট করছে, যা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনবিরোধী। এ ধরনের কার্যক্রমে প্রতিনিয়িত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে নগরবাসী। এরপরও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না জেলা প্রশাসন।

মহানগরীর ২০টি এলাকায় তামাক পণ্যের অধিকাংশ দোকানে টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন, পুরস্কার ও প্রণোদনার লিফলেট দেখা গেছে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, এসব বিজ্ঞাপন ও পুরস্কার-প্রণোদনা নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমনকি আইন লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে চলছে ধূমপান।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ সংশোধন) আইন, ২০০৫ (২০১৩)-এর ধারায় বলা আছে, বিক্রয়স্থলে তামাক পণ্যের প্যাকেট বা মোড়ক সাদৃশ্য কোনও দ্রব্য, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে না। তামাক ব্যবহারে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোনও উপহার, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান আইনত দণ্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের এই ধারা অমান্যকারীকে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের দোকান নিষিদ্ধ। সেইসঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি অপরাধ।

মহানগরীর রূপসা, টুটপাড়া, পিটিআই, রয়্যাল মোড়, সাতরাস্তা, ময়লাপোতা, শিববাড়ী, ফেরিঘাট, রেলস্টেশন, সাত নম্বর ঘাট, নিউমার্কেট, সোনাডাঙ্গা, গল্লামারী, জিরো পয়েন্ট, নিরালা, শান্তিধাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, বয়রা ও বিএল কলেজ মোড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, তামাক পণ্য বিক্রেতাদের দোকান বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানির পক্ষ থেকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হয়েছে। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে কোম্পানিগুলোর হ্যান্ডবিল, স্টিকার ও লিফলেট। বেশি বিক্রির ওপর দোকানিদের দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উপহার। এছাড়া সিগারেট, বিড়ি কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোম্পানির লোগো সংবলিত শার্ট-প্যান্ট পরে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচারণা। যা আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

সিগারেট কোম্পানিগুলো ক্রেতা-বিক্রেতাসহ ধূমপানকারীদের রঙছটা বিজ্ঞাপন আর পুরস্কার প্রণোদনায় আকৃষ্ট করছে, যা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনবিরোধী

ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, হাসপাতাল চত্বর, বাস টার্মিনাল, যাত্রীছাউনি, গণপরিবহন, সরকারি বিভিন্ন অফিস, আদালত চত্বর, আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে ধূমপান চলছে। অথচ আইনে খোলা জায়গা ও গণপরিবহনে ধূমপান করলে ৩০০ টাকা জরিমানার বিধান আছে। ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে। কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।

তারা বলছেন, আইন লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। দিচ্ছে উপহার সামগ্রী। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উৎসাহিত হচ্ছেন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাক বিক্রি করা হচ্ছে। এরপরও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না জেলা কিংবা উপজেলা প্রশাসন।

বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের সদস্য ও সোশ্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইনক্রিজিং অ্যানালাইসিস মুভমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী মো. মাছুম বিল্লাহ বলেন, ‘প্রকাশ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিভিন্ন উপহার দেওয়া হচ্ছে। সিগারেট সরবরাহের যানবাহনে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করছে। এসব প্রচারণায় অনেকে ধূমপানে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। আইনে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও শিশু-কিশোরদের কাছে অবাধে সিগারেট বিক্রি করছে। আইনবহির্ভূত এসব কার্যক্রমের মূলে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) ও জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই)। আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি তারা আইনের বিরোধিতা করছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর অনুরোধ জানিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।’ 

এইড ফাউন্ডেশনের প্রকল্প কর্মকর্তা কাজী হাসিবুল হক বলেন, ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তরুণদের সম্পৃক্ত করে ব্যাটল অব মাইন্ডস’ ও এক্সসিড নামে প্রচারণামূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণদের কাছে নিজেদের পরিচিতি ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ দিয়েছে। যা আইন লঙ্ঘন করে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আড়ালে ভালো ইমেজ গড়ে তোলার অপচেষ্টা।’ 

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, এসব বিজ্ঞাপন ও পুরস্কার-প্রণোদনা নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ

সাতরাস্তা মোড়ের শামীম হোটেলের মালিক মো. শামীম হোসেন বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলোর প্রচারণায় রেস্টুরেন্টগুলো ধূমপানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে রেস্টুরেন্টগুলোতে আসেন অনেকে, অথচ ধূমপানের কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। কেউ প্রতিবাদও করে না।’

নিউমার্কেট এলাকার চা-সিগারেটের দোকানি তাইজুল ইসলাম বলেন, ‘তামাক কোম্পানিগুলো মূল্য কারসাজি করছে। তারা সিগারেটের প্যাকেটে খুচরা মূল্য যা উল্লেখ করছে, তার চেয়ে ৫-১০ শতাংশ বেশি দাম নিচ্ছে। বিক্রয় মূল্যের ওপর কর পরিশোধের বিধান থাকলেও প্রকৃতপক্ষে প্যাকেটে লেখা মূল্যের ওপর কর দিচ্ছে তারা। মাঝখান দিয়ে আমাদের কাছ থেকে যে টাকা বেশি নিচ্ছে, তার কর কিন্তু দিচ্ছে না কোম্পানিগুলো।’

সোশ্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ইনক্রিজিং অ্যানালাইসিস মুভমেন্টের প্রকল্প কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন বলেন, ‘বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও সিগারেটের কার্টনে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী না দেওয়া, ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপহার সামগ্রী দেওয়া, বিনামূল্যে সিগারেট বিতরণ, শিশু-কিশোরদের কাছে বিক্রি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রকাশ্যে আইন লঙ্ঘন করছে তামাক কোম্পানিগুলো। ইতোমধ্যে কোম্পানিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় নাটক ও সিনেমায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ধূমপানের দৃশ্য।’ 

গত ৩০ অক্টোবর খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট। সম্মেলনে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ লক্ষ্যমাত্রা: সিগারেট কোম্পানিগুলোর অপতৎপরতার বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ তামাক কোম্পানিগুলো এই উদ্যোগ ব্যাহত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আইন লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি, প্রণোদনা, প্রকাশ্যে ধূমপানের স্থান তৈরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দূত নিয়োগ করছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অসংক্রামক ব্যাধির চাপে বিপর্যস্ত। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনির জটিলতা, হরমোনের জটিলতা ও ফুসফুসের সমস্যার প্রধান কারণ তামাক ব্যবহার। কাজেই তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে এবং নিরুৎসাহিত করতে হবে।

আইনের তোয়াক্কা না করে চলছে তামাক পণ্যের প্রচারণা

এদিকে তামাকবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগ খুলনার উপপরিচালক ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পর্যায়েও এই কার্যক্রম গতিশীল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোকে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে। অভিযান আরও জোরালো করা হবে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘দেশজুড়ে তামাকের আগ্রাসন চলছে। প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে এই আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। এখনই আইনের কঠোর প্রয়োগ না হলে যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। একইসঙ্গে অসংক্রামক ব্যাধিতে পিষ্ট হবো আমরা।’

গত ৩১ অক্টোবর নগরীর বয়রা ও গোলখালী এলাকায় আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুমতাহিনা পৃথুলা। এ সময় তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘনের দায়ে এক ব্যক্তিকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।