শুকনো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে প্রয়োজনীয় গন্তব্যে যেতে হয় পায়ে হেটে। আর বর্ষা মৌসুমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার বা নৌযানে। ফলে হাওরের লোকজনের মুখে একটা কথা সব সময় শোনা যায়-‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও (পা)’। বর্ষাকালে হাওরে থাকে উত্তাল ঢেউ। প্রবল ঢেউ আর আফালে (হাওরের এক প্রকার বড় ধরনের ঝড়কে স্থানীয় ভাষায় আফাল বলে) হাওরের গর্ভে বিলীন হচ্ছে গ্রাম আর বাড়ি ঘর। মৃত্যুর ঝুঁকিও প্রতি মূহুর্তে। গত ৫ আগস্ট নৌকা ডুবে প্রাণ হারায় ১৮ জন ।
মৃত্যু ঝুঁকির কারণে বর্ষার সময় সমস্ত উপজেলায় স্কুলগুলো বন্ধ থাকে। শুকনো মৌসুমে চলাচলের জন্য নেত্রকোনার হাওর উপজেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু কাজ হলেও সার্বিক উন্নয়ন এখনও হয়নি। হাওরবাসী তাদের জীবন মানের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন। জেলার দশ উপজেলার মধ্যে হাওর উপজেলাগুলো হলো-মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুরী, আটপাড়া এবং কলমাকান্দার কিছু অংশ। হাওরবাসীর সবচেয়ে বড় দুঃখ ধনু নদী আর হাওরের বিশাল বিশাল ঢেউয়ে গ্রাম নিশ্চিন্ন হওয়া।
গত পাঁচ বছরে খালিয়াজুরী উপজেলার কমপক্ষে ৮টি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামগুলো মধ্যে হেমনগর, লক্ষীপুর, সওতাল, নগর, নয়ানগর, শীবপুর উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রামের লোকজন অন্য গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এখনও নিজস্ব ঘরবাড়ি তারা নির্মাণ করতে পারেনি। অসহায় অবস্থায় চলছে তাদের মানবেতর জীবন। হাওর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে মূল উপজেলা খালিয়াজুরী সদর। বর্ষাকালে এ হাওরের গ্রামগুলো পরিণত হয় দ্বীপে। সন্ধ্যার পর ভয়ে, আতংকে কেউ নৌকায় চলাচল করে না। সামান্য ঝড় হলেই বন্ধ হয়ে যায় নৌ চলাচল। কখনও কখনও টানা ২-৩ দিনও যোগাযোগ বন্ধ থাকে। হাওর এলাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ, উন্নয়ন কর্মী মহসিন মিয়া এবং চাকরিজীবি বর্ষা সরকারসহ এলাকার লোকজন বলেন, বর্ষাকালেই হাওরের যত সমস্যা। ঝড় বৃষ্টি হলেই নৌ যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তারা আরও বলেন, ধনু নদী দিয়ে প্রতিদিন সিলেট আর ঢাকায় শত শত বড় বড় কার্গো পণ্য নিয়ে চলাচল করে। এতে করেও ভাঙছে গ্রাম। প্রতি বছর হাওরের ভাঙনে গ্রাম বিলীন হলেও গ্রামগুলো রক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। চারদিকে বাঁধের ব্যবস্থা করলে গ্রামগুলো ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেতো। তারা বলেন, হাওর উন্নয়ন বোর্ড আছে নামে, কাজে নেই। এ নিয়ে এলাকাবাসী সব সময় অভিযোগ করে আসছেন।
এখানকার হাওর উপজেলাগুলোতে বোরো ধান ব্যাপক উৎপন্ন হয়। কিন্তু উৎপাদিত ধান সংরক্ষণের জন্য নেই কোনও সরকারি গুদাম। এমন কি বেসরকারি গুদামও নেই। ফলে অনেক সময় সংরক্ষণের অভাবে ধান বিনষ্ট হয়।
হাওর উপজেলায় পাওয়া যায় লাখ লাখ টন মাছ। যা প্রতিদিন ঢাকায় রফতানি হচ্ছে। কিন্তু মৎস্য সংরক্ষণের জন্য নেই কোনও হিমাগার। নেই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। হাওরের পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন একজন লেখক সঞ্জয় সরকার বলেন, সুবিধাবঞ্চিত এবং ভূমিহীন হাওরের মানুষ এই যুগে এসেও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে খালিয়াজুরী উপজেলা সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত।
নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে খালিয়াজুরীর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। এই উপজেলায় ছোট বড় হাওর আছে ৭৯টি। বছরের ৭-৮ মাস হাওরের চলাচলের একমাত্র বাহন নৌকা বা ট্রলার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের চলতে হয়।
খালিয়াজুরীর আবুল হোসেন এবং নরপুর বোয়ালী গ্রামের আব্দুল মোনায়েম বলেন, বর্ষায় জেলার হাওর উপজেলাগুলোতে হাওরের উত্তাল ঢেউয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নৌকাডুবির ভয়ে, আতংকে স্কুলে যেতে পারে না। প্রায় ৫-৬ মাস শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত থাকে। এতে তাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। এজন্য প্রয়োজন বর্ষাকালে নৌ স্কুল স্থাপন। তাহলে বাড়ির কাছের শিক্ষার্থীরা নৌকায় বসে পড়াশোনা করতে পারবে। এদিকে হাওর উপজেলাগুলোর সার্বিক উন্নয়নের জন্য হাওরবাসীকে নিয়ে হাওর উন্নয়ন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন এলাকার পর্যটক খন্দকার আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, হাওরের লোকজনই বলতে পারবেন, হাওর উপজেলার উন্নয়নে বাঁধা কোথায় এবং সমস্যা কোথায়। রাজধানীতে বসে থেকে হাওরের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, হওরের গ্রামগুলোকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে বড় ধরনের প্রকল্প নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বেশি বরাদ্দ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জরিপ চালাচ্ছে এবং প্রকল্প নেওয়া হবে।