ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ফয়সাল খানের (৩০) মৃত্যুকে ঘিরে রহস্যের দানা বাঁধছে। বাইরের দুই ব্যক্তিকে নিয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির অভিযান বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফয়সাল ও তার চার স্বজনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা হয় ১০ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে। কিন্তু মামলার আগেই রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে নিহতের বোনের বাসায় অভিযান চালায় ডিবির একটি দল।
অভিযানে ডিবির সঙ্গে থাকা দুই ব্যক্তি বাদীপক্ষের লোকজন। ডিবির ১৮ মিনিটের অভিযান শেষে রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাঁচতলা ভবনের নিচ থেকে ফয়সালকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন স্বজনরা। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
নিহত ফয়সাল জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সরিষা কাশিপুর এলাকার সেলিম খানের ছেলে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে নগরীর কেওয়াটখালী পাওয়ার হাউস রোডে বড় বোনের বাসায় থেকে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার সঙ্গে প্রায় চার বছর প্রেমের সম্পর্ক ছিল ওই এলাকার এক তরুণীর। ১৫ নভেম্বর তরুণীর বিয়ে ঠিক হওয়ায় ফয়সাল ওই তরুণীর সঙ্গে আগে তোলা ছবি পাত্রের কাছে পাঠিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য তার বাবা ঈশ্বরগঞ্জ থানা ও ডিবিতে পর্নোগ্রাফি আইনে অভিযোগ দেন। কিন্তু মামলা রেকর্ড হওয়ার আগেই কেওয়াটখালী বড়বোনের বাসায় অভিযানে যায় ডিবি।
অভিযানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ১০ নভেম্বর রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে বাসার নিচের কলাপসিবল গেট খুলে দিচ্ছেন ফয়সালের বোন জামাই মোহসিনুল হক। এ সময় ডিবি পুলিশ লেখা কটি পরিহিত চার জন, কটিবিহীন চার জন সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে যান। পোশাকবিহীন একজনের হাতের ওয়াকিটকি ছিল, দেখে পুলিশ সদস্য মনে হয়। বাকি তিন জনের মধ্যে শেষের দিকে থাকা দুই জনের একজনের মুখে মাস্ক ও একজনের মাথায় ক্যাপ পরা দেখা যায়।
ডিবি নিশ্চিত করেছে, অভিযানে মোট ছয় জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। অন্য দুই জনের একজন ওই তরুণীর খালাতো ভাই আসিফ সাইফুল্লাহ বলে জানিয়েছেন ফয়সালের স্বজনরা। আরেকজনের পরিচয় এখনও মেলেনি।
অভিযান চলাকালে ডিবির সঙ্গে থাকা আসিফ ও মুখে মাস্ক পরা অন্য ব্যক্তি সরাসরি ৫ তলা বাসার ছাদে চলে যান বলে জানান নিহতের বোন জামাই মোহসিনুল হক।
মোহসিনুল জানান, বাসার বাইরে ডিবি পুলিশ দেখে দোতলার ভিন্ন দরজা দিয়ে ফয়সাল পাঁচতলায় ও তার স্ত্রী (ফয়সালের বোন) তৃতীয় তলায় চলে যান। এর আগে বাসার নিচে ডিবি জানায়, ফয়সাল ও তার বোনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের ধরতে এসেছেন তারা। ডিবি বাসায় তল্লাশি শেষে তৃতীয় তলায় ওঠে। তখন ছাদের দিক থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন আসিফ ও সঙ্গে থাকা অন্যজন। তারা বলতে থাকেন, ওপরে ফয়সাল নেই। পরে বাসা ত্যাগ করেন ডিবি ও সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা।
মোহসিনুল হক বলেন, ‘ওই দুই জন ছাদে যাবে তা বুঝতে পারিনি। ফয়সাল এমন অপরাধী নয় যে ৫ তলার ছাদ থেকে লাফ দেবে। বাইরের দুই ব্যক্তি যদি ডিবির সঙ্গে না ঢুকতো, ছাদে না যেত, তাহলে ধরে নিতাম ডিবির পরিচয় পেয়ে ভয়ে সে লাফ দিয়েছে। এখানেই আমাদের সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। ডিবি কেন বাইরের লোকদের বাসায় নিয়ে এলো এবং তারা কেন ছাদে গেলো? আমাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে বা সবাই একসঙ্গে ছাদে যেতে পারতো, এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছি না। এ জন্যই মনে হচ্ছে ফয়সালের মৃত্যু রহস্যেঘেরা।’
ফয়সাল আহত হওয়ার ঘটনায় গত ১২ নভেম্বর কোতোয়ালি মডেল থানায় তার বাবা সেলিম খান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাসায় ঢুকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করে তাকে বাসার নিচে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ করা হয় ওই মামলায়। তরুণীর বাবাসহ ছয় জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচ জনকে আসামি করা হয় মামলায়। এ ঘটনায় রবিবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম খান।
মোহসিনুল হক অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘প্রথমে পুলিশ আমাদের মামলা নিতে চায়নি। পরে মামলা নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু পুলিশ এখনও আসামি গ্রেফতার করতে পারছে না। একজনকে গ্রেফতার করলেই কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছে, তা বেরিয়ে আসতো। আমরা চাই, মূল ঘটনার সত্যতা বের হোক। যারা জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ ডিবির ওসি সহিদুল ইসলাম বলেন, মামলা হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রিকুইজিশন পেয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন এসআই সোহরাব উদ্দিন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখালে তিনি ছয় জনকে ডিবি টিমের পুলিশ সদস্য হিসেবে নিশ্চিত করেন। বাকি দুই জন সোর্স হিসেবে কাজ করেছে বলে জানান।
বাইরের লোক নিয়ে অভিযানে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, আসামি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছিল। তারা কেন ছাদে গেলো প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করলেই বের হয়ে আসবে।
মামলা নথিভুক্তির আগে ডিবির অভিযান, পুলিশ সদস্যের সঙ্গে বাইরের লোক যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ফয়সালের স্বজনেরা। ফয়সাল খান, তার তিন বোন ও চাচির বিরুদ্ধে তরুণীর বাবার করা মামলার অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মামলায় সংবাদপ্রাপ্তির তারিখ ও সময়ের জায়গায় ১১ নভেম্বর ১২টা ৫ মিনিট লেখা হয়েছে। ঈশ্বরগঞ্জ থানা পুলিশের ভাষ্য, ১০ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে মামলা নথিভুক্ত হয়। থানা পুলিশ রাত ১২টা ৫ মিনিটে মেয়ের বাবার কাছ থেকে সংবাদ পেয়েছে দেখালেও এর আগে রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে ময়মনসিংহ নগরীর কেওয়াটখালিতে বড় বোনের বাসায় অভিযানে যায়।
এ বিষয়ে নিহতের বাবা সেলিম খান বলেন, তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমার ছেলেকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড দাবি করে এর সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন তিনি।
ময়মনসিংহ জেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি এ এইচ এম খালেকুজ্জামান জানান, আইন অনুযায়ী পুলিশ বাদীপক্ষের লোকজন নিয়ে আসামিকে ধরতে অভিযানে যেতে পারে না। কোনও বাসায় তল্লাশি চালাতে হলে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিতে পারে। যেহেতু পুলিশের সঙ্গে বাইরের লোক প্রবেশ করেছে, আইন লঙ্ঘন হয়েছে। এখন পুলিশের দায়িত্ব হলো হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করা।
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ওই তরুণীর পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতেই ডিবির টিমকে পাঠানো হয়েছিল। চিনিয়ে দেওয়ার জন্য দুই জন সঙ্গে গিয়েছিলেন। ঘটনা জানার পরই মামলা নেওয়া হয়েছে।