র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু: কোনও অভিযোগ নেই পরিবারের, করবে না মামলাও

নওগাঁয় র‌্যাব হেফাজতে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিনের (৪০) বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করায় বিস্মিত হয়েছেন তার স্বজন ও সহকর্মীরা। বিস্মিত হলেও তাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই ঘটনায় তাদের কোনও অভিযোগ নেই এবং মামলাও করবেন না স্বজনরা।

গত বুধবার (২২ মার্চ) নওগাঁ সদরের চন্ডীপুর ইউনিয়নের ভূমি অফিসের সহকারী জেসমিনকে আটক করেছিল র‌্যাব। পরদিন তার বিরুদ্ধে রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হক।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, চাঁদপুরের হাইমচর থানার গাজী বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আল আমিন ও নওগাঁর সুলতানা জেসমিনসহ অজ্ঞাত দুই-তিন ব্যক্তি এনামুল হকের নাম-পদবী ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন লোকজনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

তবে জেসমিনের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগ বিশ্বাস করতে পারছেন না তার স্বজন, প্রতিবেশী ও সহকর্মীরা। জেসমিনের মামা নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু বলেন, ‘আমার ভাগনি অত্যন্ত সরল মানুষ। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ছোট্ট একটা চাকরি করে ছেলেটাকে মানুষ করছে। তার ছেলের লেখাপড়ার খরচের টাকা অনেক সময় আমাকে দিতে হয়। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ নিলে তো অভাব-অনটন থাকতো না। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ সত্য নয়। আমার ভাগনি চক্রান্তের শিকার। আমার বিশ্বাস, সঠিকভাবে তদন্ত করলে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।’

জেসমিনের একমাত্র ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

জেসমিনের ভাই সোহাগ মিয়া বলেন, ‘আমার বোনের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা সবাই জানে। আর কোনও কথা বলতে চাই না। মামলাও করতে চাই না। আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। অভিযোগ করে কী হবে।’

নওগাঁ সদরের চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করছিলেন জেসমিন। গত আট বছর ধরে শহরের জনকল্যাণপাড়ার দেলোয়ার হোসেন দুলালের বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলেন। প্রায় ১৭ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছেলে শাহেদ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন।

জেসমিন যে বাসায় ভাড়া থাকতেন তার মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জেসমিন দীর্ঘদিন ধরে আমার বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কখনও তার অস্বাভাবিক চলাফেরা চোখে পড়েনি। তার মতো সহজ-সরল মানুষ অন্যের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে চাকরি দেওয়ার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করবে, এটি বিস্ময়কর।’

কী ঘটেছিল?

স্বজনদের দাবি, বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার পথে সুলতানা জেসমিনকে রাস্তা থেকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় র‍্যাব।

র‍্যাবের দাবি, একজন সরকারি কর্মকর্তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাকরি দেওয়ার নামে অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল জেসমিনের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তবে আটক হওয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

র‍্যাব বলছে, নওগাঁয় র‍্যাবের কোনও ক্যাম্প না থাকায় তাকে আটকের পর পাশের জয়পুরহাট ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ বিষয়ে র‍্যাব-৫-এর অধিনায়ক রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘যে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রতারণার অর্থ লেনদেন হতো, সেটির সূত্র ধরে জেসমিনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে। ক্যাম্প যেহেতু দূরে, তাই আটকের পর গাড়ির ভেতরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন র‍্যাব সদস্যরা তার মোবাইল নিয়ে লক খুলতে বললে ঘাবড়ে যান, ঘামতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি পাসওয়ার্ড দিলে আমরা অভিযোগের কিছু সত্যতা পাই। এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে তিনি বমি করতে শুরু করেন। তখন আমরা তাকে দ্রুত নওগাঁ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, ‘নওগাঁ সদর হাসপাতালে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন থাকার পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাজশাহীতে নেওয়ার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে মারা যান। সকালে তার মৃত্যু হলেও স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয় শনিবার বিকালে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের বুঝিয়ে দেয় র‍্যাব। এ ঘটনায় এখনও কেউ অভিযোগ দেয়নি, মামলাও হয়নি।’