রাজশাহীতে শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ বিশিষ্টজনদের

দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী নগরীর সোনাদীঘির মোড়ে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এই শহীদ মিনার স্থাপনে শুরু থেকেই বাধা দিয়ে আসছিল জেলা পরিষদ। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে আবারও শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল।

অথচ চেয়ারম্যান হওয়ার আগে জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। মীর ইকবালের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।

সোমবার (২৯ মে) ১৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট নির্মাণের প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। গণমাধ্যমকে দেওয়া বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘রাজশাহীবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সোনাদীঘির মোড়ে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু ও ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মীর ইকবাল ও বিপুল সংখ্যক সংস্কৃতিকর্মী।’

বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মীর ইকবাল শহীদ মিনারের স্থানে একটি মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে সয়েল টেস্টের জন্য লোক পাঠানো হলে জনপ্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে যায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং মুক্তিযোদ্ধারা ইতোমধ্যে এ ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন।’

বিবৃতিতে তারা আরও উল্লেখ করেন, ‘আমরা মনে করি, শহীদ মিনারের স্থানে কোনও অবস্থায় মার্কেট নির্মাণ সমীচীন হবে না। লাখো শহীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা বা শহীদ মিনারকে অবরুদ্ধ করে মার্কেট নির্মাণ কোনও অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা জেলা পরিষদকে এ ধরনের আত্মঘাতী ও শহীদদের প্রতি অবমাননাকর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানাই এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই। জনরোষ বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে যুক্তিযুক্ত।’

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন রামেন্দু মজুমদার, সুজেয় শ্যাম, আবেদ খান, ডা. ফওজিয়া মোসলেম, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুছ, ড. মুহম্মদ সামাদ, প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান, অ্যাডভোকেট আবদুন নূর দুলাল, অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া, ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, প্রফেসর ড. এহতেশামুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, সাংবাদিক হারুন হাবিব, সাংবাদিক শ্যামল দত্ত, কেরামত মওলা ও মো. আহ্কাম উল্লাহ।

এর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জায়গায় জেলা পরিষদের মার্কেট নির্মাণের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছেন। গত বুধবার সকাল ১০টায় নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে জেলা কমান্ড, মহানগর কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালিত হয়।

বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধনে বক্তারা বলেছেন, রাজশাহীতে ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ; এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ও স্মৃতিতে সমৃদ্ধ শিক্ষানগরী রাজশাহী। অথচ ঐতিহ্য বহনকারী এমন একটি শহরে শহীদদের স্মরণে কোনও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নেই। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোনাদীঘি সংলগ্ন পুরাতন সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিত্যক্ত জায়গায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই আন্দোলন ও ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল নিজেও ছিলেন। অথচ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে মীর ইকবাল লোভের কারণে সব ভুলে গেছেন। আমরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। সেখানে মার্কেট নির্মাণের অপচেষ্টা করলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান বলেন, ‘জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লোভের কারণে শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করতে চাচ্ছেন। তিনি কার স্বার্থে মার্কেট নির্মাণ করতে চাচ্ছেন, সেটি আমরা জানতে চাই।’

মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনার ক্ষমতা নেই, শহীদ মিনারের স্থানে মার্কেট নির্মাণ করার। আমরা সেখানে শহীদ মিনার করেই দেখাবো।’

মহানগর ইউনিট কমান্ডের কার্যকরি সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক জিনাতুন নেসা তালুকদার বলেন, ‘যেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে জেনেবুঝে কীভাবে মার্কেট বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের বুঝে আসে না। ১৯৪৮ থেকে ৫২ ভাষাশহীদ, ১৯৭১ সালের ৩০ লাখ শহীদের আত্মা বড় কষ্ট পাচ্ছে, আপনার বর্তমান কর্মকাণ্ডের জন্য।’

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বিভাগীয় সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন খন্দকার বলেন, ‘জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক মার্কেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত এই সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য লজ্জাজনক। মীর ইকবাল মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কীভাবে শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট নির্মাণের কথা চিন্তা করলেন। অথচ আগের চেয়ারম্যানের সময় তিনিও আন্দোলন করেছিলেন। তার আশেপাশের লোকেরা মীর ইকবালকে বিপথগামী করেছেন।’

মানববন্ধনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক মহানগর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জায়গায় মার্কেট অথবা শপিংমল অথবা অন্য যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের চিন্তা করেছেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। আমাদের ভাষা-আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের শ্রদ্ধায় শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে অনেক স্থানে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এতদিনেও রাজশাহীতে কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, এমপি ফজলে হোসেন বাদশার নেতৃত্বে এই স্থানটি নির্ধারণ করা হয়েছে। সাবেক মেয়র লিটন ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। অথচ সেখানেই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মার্কেট করতে চাচ্ছেন। এটি কোনোদিন হতে দেওয়া হবে না।’

একই দাবিতে রবিবার (২৮ মে) বিকালে নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি করেছে রাজশাহী সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কল্পনা রায়ের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১’র বিভাগীয় সমন্বয়কারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসান খন্দকার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার ঘোষ, রাজশাহী থিয়েটারের সভাপতি নিতাই ঘোষ, মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার রাজশাহীর সভাপতি আব্দুল লতিফ চঞ্চল, খেলাঘর আসর রাজশাহীর সেক্রেটারি আখতার কাজল, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অঞ্জনা সরকার, মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগারের সভাপতি আব্দুল লতিফ চঞ্চল, রুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি মোহাম্মদ ইসফাক ইয়াসির ইপু প্রমুখ।

এ সময় বক্তারা বলেন, রাজশাহী বিভাগীয় শহর হলেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নেই। এই শহীদ মিনার নির্মাণে যে জায়গাটি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানেই জেলা পরিষদ বারবার চক্রান্ত করছে। এর বিরুদ্ধে রাজশাহীবাসী সোচ্চার রয়েছে। এবার সেখানে নতুন করে মার্কেট নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে। এটি মেনে নেওয়া হবে না।