দাম চড়া, রোজার কোনও পণ্যে সুখবর নেই

সোমবার (১১ মার্চ) সন্ধ্যায় দেখা গেছে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ। মাসটি পুণ্যের হলেও বেশি মুনাফার আশায় থাকেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। লাভ করতেও মরিয়া তারা। একটি রীতিতে পরিণত করেছে এসব ব্যবসায়ীরা। ব্যতিক্রম ঘটছে না এবারও। এবার মাসখানেক আগে থেকে নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছেন তারা। সরকার এবার রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের নানা আশ্বাস দিলেও সম্ভব হচ্ছে না। ছোলা, বেগুন, লেবু, মাছ-মাংস প্রায় সবই চড়া দামে কিনতে হচ্ছে।

রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের খরচ আরও বাড়তে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই চিড়েচ্যাপ্টা সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষ। তার ওপর রোজাকে ঘিরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী গতি এ চাপকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজান মাসের বাড়তি খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন সাধারণ মানুষ।

রাজশাহীর বাজার চিত্রে দেখা যায়, রোজার মাস দেড়েক আগে থেকেই ছোলা, অ্যাংকর, মুগসহ সব ধরনের ডালের দাম বেড়েছে। খেজুরের দর লাগামহীন। চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। সয়াবিন তেলের দাম যদিও কিছুটা কমেছে, কিন্তু তা যৎসামান্য। ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দামও চড়া। দাম বাড়ার তালিকা থেকে বাদ পড়েনি চিড়া-মুড়িও। সবজির মধ্যে ইতোমধ্যেই বেগুন, শসা, লেবুসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে।

এক বছরের ব্যবধানে তুলনা করলে দেখা যায়, নিত্যপণ্যে খরচ অনেকখানি বেড়েছে। ছোলার দাম বেড়ে প্রতি কেজি এখন ১১০ থেকে ১২০ টাকা হয়েছে। গত বছর যা ৮০ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে কেনা গেছে। অ্যাংকর ডাল এবার ৯০ টাকা ছুঁয়েছে। গত বছর এ সময়ে যা ৭০ টাকায় কেনা গেছে। গত বছর রোজার আগে মসুর ডালের দাম সেভাবে না বাড়লেও এবার ছোলার সঙ্গে মসুর ও মুগ ডালের দামও বেড়েছে। গত বছর এ সময় ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়া বড় দানার মসুর ডাল এবার ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ছোলা

দেশি পেঁয়াজের দর গত বছর যেখানে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে ছিল; এবার তা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রোজায় মুখরোচক নানা খাবারে চিনি ব্যবহার হয়। এর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এসব খাবারের দামও বাড়তে পারে। বাজারে খোলা চিনির কেজি এখন ১৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর যা ১১০ ছিল। সাধারণ মানের খেজুর গত বছর ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি। এবার তা ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের কেজি গত বছর ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা ছিল। এবার ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত বছর আলুর কেজি ছিল ২০ থেকে ২২ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা পর্যন্ত।

নগরীর বহরমপুর এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, মাসের সীমিত বেতনে মাসের বাজার খরচ সামলাতেই ঘাম ছুটে যায়। সেখানে রোজাকে সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়েছে। রমজানে কীভাবে বাজার খরচ সামাল দেবো এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

নগরীর অটোরিকশাচালক কাশেম আলী বলেন, রোজাকে ঘিরে যে হারে দাম বেড়েছে তা আমাদের মতো নিম্নআয়ের মানুষের পকেটে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। হতাশার সঙ্গে তিনি বলেন, রোজায় কী হবে জানি না!

সোমবার (১১ মার্চ) বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে এখন এক কেজি সাধারণ মানের খেজুরের দাম ৩০০ টাকা। গত বছর রোজায় এ খেজুরের দাম ছিল ১২০-১৫০ টাকা কেজি। এছাড়া ভালো মানের খেজুর ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। যা গত রমজানের থেকে ৫০০ টাকা বেশি।

অন্যদিকে, রমজানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছোলা সকালে বিক্রি হচ্ছিল ১১০ টাকা কেজি দরে। দুপুরে ১২০ ও বিকালে ১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০ টাকা। একইভাবে খেসারির কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি দরে। আগেরবার ছিল ৮০ টাকা কেজি। এ ছাড়াও ডালের মধ্যে প্রতি কেজি মোটা, মাঝারি ও সরু দানার মসুর ১০৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে প্রতি কেজি অ্যাংকর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। আর মুগ ডালের কেজি পড়ছে ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা।

নগরীর সাহেববাজারের মুদি দোকানি লুৎফর রহমান বলেন, রোজার কোনও পণ্যে সুখবর নেই। এবার রোজার অনেক আগেই থেকে ছোলা খেসারি ডালসহ অন্যান্য সব ডালের দাম চড়া। আমাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়েছে।

খেজুর

যদিও রোজায় পণ্যের দামের লাগাম টানতে সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি খেজুর, চিনি, সয়াবিন তেল ও চাল আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছিল। তবে সয়াবিন তেল ছাড়া অন্য তিন পণ্যে দাম সামান্যও কমেনি বরং বেড়েছে।

অন্যদিকে, প্রকারভেদে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর রোজার আগে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সেই দাম এখন প্রায় তিন গুণ। সেই হিসেবে এক কেজি পেঁয়াজে বেশি খরচ হবে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আদা ২০০, চায়না রসুন ২০০ ও দেশি রসুন ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত রমজান থেকে প্রায় প্রতি কেজি ১০০ টাকা বেশি।

বাজারে দুই দিনের ব্যবধানে বেড়েছে মুরগির দাম। শুক্রবার ব্রয়লার ২০০, সোনালী ২৯০, দেশি মুরগী ৪৮০ টাকা বিক্রি হলেও সোমবার প্রতিটি মুরগিতে বেড়েছে ২০ টাকা কেজি। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা দরে। সেই সঙ্গে খাসির মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়। গরুর মাংসের পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে প্রতি কেজি ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া, সোনালি মুরগি ও কক মুরগিরও দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৩১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কাঁচাবাজারে প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ৬০, শসা ৮০, মুলা ৩০, ঝিঙে ৬০, বেগুন ৪০, পেঁপে ৩০, লাউ প্রতি পিস ৪০, মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০, টমেটো প্রতি কেজি ৫০, ফুলকপি ৩০, আলু ৩৫, কাঁচা মরিচ ১০০, মটরশুঁটি ৮০, গাজর ৪০ ও শিমের বিচি ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে সব ধরনের মাছের দাম বাড়তি যাচ্ছে। পাঙাশ মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকায়, তেলাপিয়া ২২০ থেকে ২৪০, চাষের শিং মাছ ৪৮০ থেকে ৫০০, রুই ৩২০ থেকে ৩৫০, চাষের কই ৩০০, দেশি ছোট কই ৬০০ থেকে ৭০০, পাবদা মানভেদে ৩০০ থেকে ৩৫০, শোল মাছ একটু বড় সাইজের ৯০০, চিংড়ি ৮০০, কাতলা মাছ ৩২০ থেকে ৩৫০, বোয়াল ৭০০ থেকে ৮০০ ও টেংরা মাছ ছোট সাইজের ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রোজাকে কেন্দ্র করে বাজার তদারকিতে নিয়মিত মাঠে রয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। রাজশাহী বিভাগীয় অফিসের উপ-পরিচালক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, রমজানের সময় আমাদের মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে। বিশেষ অভিযানও চালানো হবে। কেউ কোনও পণ্যের দাম না বাড়াতে পারে সেদিকে খেয়াল থাকবে।

প্রতিবছর রোজাকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতাকে ‘দুঃখজনক‘ উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে নিত্যপণ্যের দামে ছাড় দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেন। আর আমাদের এখানে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। আমাদের দেশে এ সময়ে ভোক্তার পকেট কাটার প্রতিযোগিতা চলে। বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে একে একে সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজারের যে চিত্র, তাতে সঙ্গত কারণেই রোজার বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সাধারণ ভোক্তা।