আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন

সারা দেশে যখন ঈদুল আজহার আনন্দে ভাসছে মানুষ, তখন পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার কৃষকরা দাঁড়িয়ে আছেন চরম অসহায়ত্বের মুখোমুখি। চলনবিলের বুক চিরে হঠাৎ করেই নেমে এসেছে আগাম বন্যা। মাত্র ছয় থেকে আট ঘণ্টার ব্যবধানে বিলাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। মুহূর্তেই পানির নিচে তলিয়ে গেছে সোনালি রঙের পাকা ধানের ক্ষেত।

দিলপাশার ও খানমরিচ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি এখন জলমগ্ন। শত শত বিঘা জমির পাকা ধান পানির নিচে। কৃষকের দীর্ঘদিনের ঘাম, স্বপ্ন আর অপেক্ষার ফসল আজ ভাসছে সেই পানির স্রোতে।

শ্রমিক সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষকের দুর্দশা। দিনে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদের ছুটিতে অনেকেই নিজ গ্রামে চলে গেছেন, আবার কেউ কেউ এমন দুরূহ পরিবেশে কাজ করতে অনিচ্ছুক। ফলে বাধ্য হয়েই ঈদের দিন কাস্তে হাতে নিজের ধান নিজেই কাটতে নেমেছেন অনেক কৃষক। ঈদের খুশি ভুলে, পরিবারের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে তারা চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব ধান ঘরে তোলা যায়।

কৈডাঙ্গা গ্রামের কৃষক কেফায়েত আলী বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা ভাবছিলাম ঈদের পরে ধান কেটে ফেলবো। হঠাৎ বানের পানি আইসা পড়লো। ক্ষেতের মধ্যে এখন কোমর পানি। কামলা পাই না, পাইলেও টাকা চায় আকাশছোঁয়া।’

দিলপাশার ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘ঈদের দিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাসিমুখে ঈদের মাঠে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ঈদের দিন নামাজ বাদ দিয়ে আমি নিজে কাঁচি (কাস্তে) হাতে ধান কাটছি পানির মধ্যে।’

খানমরিচ ইউনিয়নের কৃষাণী রওশন আরা প্রতিবেদককে দেখে বলেন, ‘সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় অন্ধকারে স্বামীর সঙ্গে ধান লাগাইছি লোকলজ্জার ভয়ে। সেই ধানই এখন পানির নিচে। এত কষ্ট করে কী লাভ হইলো?’

ঈদের ছুটিতে পাওয়া যাচ্ছে না ধানকাটার শ্রমিকও

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙ্গুড়ার অনেক জমিতে এখন কোমরসমান পানি। এই পরিস্থিতিতে কিছু কৃষক পাকা ধানের ওপরের অংশ কেটে পলিথিনে ভাসিয়ে তা শুকনো স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সমস্যা সেখানেই জমি থেকে ধান তুললেও তা শুকানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা বা সরঞ্জাম নেই। ফলে অনেকক্ষেত্রেই সেই ধানও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ভাঙ্গুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের কৃষিবিদ শারমিন জাহান জানান, আগাম বন্যায় কিছু নিচু জমির ধান ডুবে গেছে। তবে অধিকাংশ কৃষক ধান কেটে ফেলেছেন। ঈদের পরে শ্রমিক পেলে বাকিগুলোও কেটে নেওয়া যাবে। এখন পানি স্থিতিশীল আছে।

স্থানীয় কৃষক ও বাসিন্দারা জানান, গত ১০-১২ বছরে এমন আগাম বন্যা আর দেখেননি তারা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অনিয়মিত ও ভারী বর্ষণ, নদনদীর নাব্যতা হ্রাস সব মিলে চলনবিল এলাকায় দেখা দিচ্ছে নতুন এক বিপর্যয়।

একজন প্রবীণ কৃষক বলেন, ‘বছরের পর বছর আমরা ধান চাষ করি, কিন্তু এবার যে হঠাৎ এমন পানি আসবে, তা ভাবতেই পারিনি। এত কষ্টে ফলানো ধান চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।’

ভাঙ্গুড়ার কৃষকরা শুধু নিজেদের পরিবারের খাদ্য জোগান দেন না, দেশের খাদ্যনিরাপত্তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই এলাকার কৃষির ওপর নির্ভর করে হাজারো পরিবার। একটি মৌসুমের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং খাদ্যচক্রে বড় এক ধাক্কা। এখন কৃষকরা তাকিয়ে আছেন সরকারের দিকে তাদের দাবি জরুরি সহায়তা, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং ভবিষ্যতে এমন আগাম বন্যা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ।