পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গত বছরের তুলনায় পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এরপরও রাজশাহীতে সিন্ডিকেট করে কৌশলে চামড়ার দরে পতন ঘটিয়েছেন আড়তদাররা। এর পেছনে গরুর ‘লাম্পি স্কিন’ রোগ, অ্যানথাক্স ও চামড়ার মান খারাপের মতো অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন তারা। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অসুস্থ কোরবানির পশু বিক্রির সুযোগ নেই। হাট বা খামারে বিক্রি হয়নি এ ধরনের গরু। আর অসুস্থ গরু কোরবানি হয়নি। কাজেই রোগের অজুহাত ভুয়া।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘কোরবানির জন্য নিখুঁত পশুর প্রয়োজন হয়। পশুকেও হতে হয় সুস্থ। এ ছাড়া পশুর দৃষ্টি, হাঁটাচলাও পরীক্ষা করে কোরবানি করা হয়। এ ধরনের পশু কোরবানি হলে কবুল হয়। অসুস্থ পশু কোরবানি দেওয়া জায়েজ নয়।’
এ বছর সরকার চামড়ার দর প্রতি বর্গফুটে পাঁচ টাকা বাড়ালেও বরাবরের মতো সেই সিন্ডিকেটই সক্রিয় থেকে ইচ্ছে মতো দরের পতন ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে চামড়া বিক্রি হয়েছে অর্ধেক দরে। আর এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন রাজশাহী জেলা ও মহানগরের তিন হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী।
এ ছাড়া সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দর এক হাজার ১৫০ টাকা ও খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২২ থেকে ২৭ টাকা ও বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করে দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু ছাগল অথবা ভেড়ার চামড়ার দর পাওয়া যায়নি। অনেকে এই চামড়া নদী ও পুকুরে ফেলে দিয়েছেন।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গেলো দুই বছরের তুলনায় এবার বাজার খুব বাজে গেছে। চামড়া কেনা হয়েছে ৮০০ থেকে হাজার টাকায়। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে ৫০০ টাকাও দর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লবণ, শ্রমিক, খরচ সব মিলিয়ে সেই দর ওঠে না। উল্টো আরও লোকসান হয়। শুধু দর নির্ধারণ করে দিলেই হবে না। দর ঠিকভাবে বাস্তবায়ন, বাজার মনিটরিং, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহায়তার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। না হলে প্রতি বছরই চামড়ার দর কমতে থাকবে।
রাজশাহী জেলায় কোরবানি হয়েছে তিন লাখ ৪১ হাজার ৪৪৬টি পশু। বিভাগের আট জেলার মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে এ বছর কোরবানির দুই লাখ ৮৭ হাজার ৫২৪টি গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া সংখ্যা এক লাখ ১০ হাজার ৯০৫টি। আর ছাগলের চামড়ার সংখ্যা এক লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯টি।
জেলাগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে সংরক্ষণ করা চামড়ার সংখ্যা ৬৭ হাজার ২৪৭টি। নাটোরে ৫৩ হাজার ৫১৩টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৬ হাজার ৭৩৮টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। বগুড়ায় সংরক্ষণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ৪৩৬টি। পাবনায় সংরক্ষণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৯৮৪টি। সিরাজগঞ্জে সংরক্ষণ করা হয়েছে ২৩ হাজার ২২২টি। নওগাঁয় সংরক্ষণ করা হয়েছে ২১ হাজার ২৭৩টি। জয়পুরহাটে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬৬ হাজার ১১১টি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এ বছর কোরবানির চামড়ার মূল্যবৃদ্ধি এবং এতিমদের হক আদায়ের উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের এতিমখানা, মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন লবণ সরবরাহ করা হয়। যাতে স্থানীয়ভাবে দুই থেকে তিন মাস চামড়া সংরক্ষণ সম্ভব হয়।
অথচ সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা লাভের আশায় উল্টো লোকসান গুনেছেন। এ বিষয়ে পবার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মুস্তাক আহমেদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বেশি মূল্য নির্ধারণ করায় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় ৩০০ পিস চামড়া কিনেছি। চামড়াগুলো বিকালে বাজারে তোলার পর প্রথম ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা কেউ দর জিজ্ঞাসাও করেনি। পরে গড়ে ৩৩০ টাকা করে সব বিক্রি করে দিয়েছি। এতে ৬০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তাহলেই চামড়ার সুদিন ফিরবে।
মোহনপুর উপজেলার চামড়া ব্যবসায়ী আবদুর রউফ বলেন, ‘আমি এবার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে দেড় হাজার চামড়া কিনেছি। এগুলোতে লবণ মাখিয়ে রাখা হয়েছে। রোগাক্রান্ত গরুর থাকতে পারে। তবে তা দেখা লাগবে। ট্যানারি মালিকরা কিভাবে দাম দেয় তাও দেখার বিষয়।’
রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ বলেন, ‘কতগুলো গরুর চামড়ায় ল্যাম্পি স্কিন আছে, তা আমি দেখাতে পারবো। সংগৃহীত ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট। তবু আমরা ঝুঁকি নিয়ে এই চামড়া কিনেছি। আমরা চাই না কারও লোকসান হোক।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতোয়ার রহমান বলেন, রাজশাহীর কোনও হাটে লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত গরু বিক্রি হয়নি। রোগটি দৃশ্যমান হওয়ায় যেকোনো মানুষ দেখলেই বুঝতে পারেন। আর রোগ থাকলে সে পশু দিয়ে কোরবানি করাও সম্ভব নয়। কাজেই এমন অজুহাত ভুয়া।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, চামড়া ব্যবসায়ীরা লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত বলে দাবি করছেন। কিন্তু হাট বা খামারে এ ধরনের কোনও গরু বিক্রির সুযোগ নেই। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেলে আমরা পরীক্ষা করে দেখবো।