বগুড়ার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী, ভোট ডাকাত, দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলায় পলাতক আসামি, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ও পৌর কাউন্সিলর আবদুল মতিন সরকার অবশেষে ধরা পড়েছেন। ডিবি পুলিশের একটি দল শনিবার (২১ জুন) রাতে তাকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বসিলার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে।
তার গ্রেফতারে শুধু বিরোধী শিবিরে নয়, খোদ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝেও স্বস্তি দেখা দিয়েছে। সকলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন।
রবিবার (২২ জুন) দুপুরে ডিবির ওসি ইকবাল বাহার জানান, তাকে আদালতে তোলার প্রস্তুতি চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটি মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।
পুলিশ জানায়, কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য আবদুল মতিন সরকার বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর এলাকার মৃত মজিবর রহমানের ছেলে। তিনি আলোচিত নারী নির্যাতনকারী ও ‘ধর্ষক’ তুফান সরকারের বড় ভাই। তিনি বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হত্যা, অস্ত্র, মাদক আইনে মামলা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় একাধিক হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা রয়েছে।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি গা ঢাকা দেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দুদকের একটি মামলায় গত ১১ মার্চ আবদুল মতিন সরকারের অনুপস্থিতিতে বগুড়ার বিশেষ জজ আদালত তাকে ১৩ বছরের সাজা দেন। এ ছাড়া আদালত তাকে দুই কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৩১৫ টাকা জরিমানা করেন। এ পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কুখ্যাত ‘মাদক বিক্রেতা পরিবারের সন্তান’ খ্যাত আবদুল মতিন প্রভাবশালী এক যুবলীগ নেতার সহযোগিতায় বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের পদলাভ করেন। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তিনি মাদক ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডার বাণিজ্য, হাট-বাজার ইজারা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। হত্যা, অস্ত্র ও মাদক মামলা থাকা সত্ত্বেও তিনি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কতিপয় সুবিধাবাদী নেতার প্রভাবে স্থানীয় সরকার ও জাতীয়সহ বিভিন্ন ভোট ডাকাতিতে অংশ নেন। দলের প্রভাবে তিনি বগুড়া আন্তজেলা ট্রাক মালিক সমিতি ও জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। পরবর্তীতে নামের সঙ্গে ‘সরকার’ উপাধি যোগ করেন।
মতিন গত ২০০০ সালে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। ২০০৭ সালে ওই মামলায় তার ২৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। কয়েক বছর সাজাভোগ করার পর বেরিয়ে আসেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শহরে আলোচিত ৪-৫টি মামলার আসামি হন। র্যাব-১২ বগুড়া কোম্পানির কমান্ডার সুমিত চৌধুরীর নেতৃত্বে সদস্যরা ২০১২ সালে জুয়া ও মদের আসর থেকে মোটা অঙ্কের টাকাসহ মতিনকে গ্রেফতার করেছিলেন। গুঞ্জন রয়েছে, মতিনকে গ্রেফতার করায় র্যাব কমান্ডারকে বগুড়া থেকে বদলি হতে হয়েছিল। গ্রেফতারের কিছুদিন পর তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।
মতিন সরকারের প্রশ্রয়ে ছোট ভাই অপর সন্ত্রাসী তুফান সরকার গত ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এক ছাত্রীকে কলেজে ভর্তির প্রলোভনে তাকে শহরের চকসুত্রাপুরের বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন। তুফানের স্ত্রী, তার বড় বোন সাবেক নারী পৌর কাউন্সিলর, শাশুড়ি ও অন্যরা ওই ছাত্রী এবং তার মাকে নির্যাতনের পর মাথা ন্যাড়া করে দেন। এ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হলে এ ব্যাপারে সদর থানায় ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। পরবর্তীতে বাদীকে চাপের মুখে ও টাকা দিয়ে মামলাটি প্রত্যাহারে বাধ্য করেন।
তুফান সরকার দুদকের মামলায় ১৩ বছর সাজা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন।
নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, আবদুল মতিন সরকার সর্বশেষ বগুড়া পৌরসভার নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর প্রার্থী হন। ভোট ডাকাতির মাধ্যমে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। তার অফিসটিকে টর্চার সেলে পরিণত করা হয়েছিল। মতিনদের মতো নেতাদের কারণে বগুড়ায় আওয়ামী লীগের অনেক ক্ষতি হয়।
তারা আরও জানান, মতিন সরকার শুধু মাদক ব্যবসা, হত্যা, দখল, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি ভোট ডাকাতিতেও দক্ষ ছিলেন। বিগত বগুড়া পৌরসভার নির্বাচনে আত্মীয় এক বিএনপি নেত্রী কাউন্সিলর প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নিজ দলের এক নেত্রীকে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে পরাজিত করেছেন। সর্বশেষ গত ২০২৪ সালের ২৯ মে অনুষ্ঠিত বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশীষ পোদ্দার লিটনকে বিজয়ী করতে মতিন সরকার ও তার লোকজন মাঠে নামেন। কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি কেন্দ্র দখল করে অন্য প্রার্থীর এজেন্টদের মারপিট করে তাড়িয়ে দেন। এরপর ডাকাতির মাধ্যমে চেয়ারম্যান পদে লিটন পোদ্দার ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে তহমিনা আকতার রেশমীকে বিজয়ী করেন।
শুধু ভিন্ন রাজনৈতিক দল নয়, খোদ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী, হত্যা, অস্ত্রসহ ১৮ মামলার আসামি মতিন সরকারকে গ্রেফতারে খুশি হয়েছেন। তারা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
রবিবার দুপুরে ডিবির ওসি ইকবাল বাহার জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আগের মোট ১৮ মামলার আসামি আবদুল মতিন সরকার, সরকার পরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করেন। সর্বশেষ রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার একটি বাসায় লুকিয়ে ছিলেন। গোপনে খবর পেয়ে শনিবার রাত ১১টার দিকে তাকে ওই বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আসামি মতিনকে বিশেষ নিরাপত্তায় আদালতে তোলার প্রস্তুতি চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মামলায় তার সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।