এক যুগে রাবির চার অধ্যাপক খুন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার ঘটনায় প্রচণ্ড শঙ্কিত এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কারণ, যাই থাকুক এমন নির্মম ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কেউ। এখনও পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন সম্ভব হয়নি তবে হত্যার মোটিফ দেখে এটি উগ্রপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল কোনও পক্ষের কাজ বলেই সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা। আর এ ঘটনার পর ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দেখা গেছে গত এক যুগে এ ধরনের ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিন শিক্ষককে। এসব হত্যাকাণ্ডের ধরন প্রায় একই রকম আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকাররা ছিলেন রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে প্রগতিশীল। এছাড়াও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রগতিশীল শিক্ষক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকও মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন।    

শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নগরীর শালবাগান এলাকায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। এর আগে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে অধ্যাপক ইউনুস, ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক তাহের ও ২০১৪ সালের নভেম্বরে অধ্যাপক শফিউল ইসলাম নিহত হন।

হত্যাকাণ্ডের শিকার এসব শিক্ষকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, হত্যাকাণ্ডের ধরন ও বিচারের অগ্রগতি বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা হচ্ছে: 

অধ্যাপক ড. ইউনুস

২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে বাসা থেকে হাঁটতে বের হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় দুর্বৃত্তদের অতর্কিত হামলার শিকার হয়ে নির্মমভাবে মারা যান অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইউনুস।

হত্যাকাণ্ডের পর একই দিনে নিহত শিক্ষকের ছোট ভাই আবদুল হালিম বাদী হয়ে নগরের মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সিআইডি পুলিশ মামলার তদন্ত শেষে আট জেএমবি সদস্যকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে।

অধ্যাপক ড. ইউনুস

পরে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ছয়জনকে বেকসুর খালাস দিয়ে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে মৃত্যুদণ্ডের রায় স্থগিত করে পুনঃবিচারের আদেশ দেওয়া হয়।

পুনঃবিচারে এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুই আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন রাজশাহীর আদালত।

অধ্যাপক ড. এস তাহের  

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর নিজ বাসভবনের পেছনে একটি সেপটিক ট্যাংকের ভেতর তার লাশ পাওয়া যায়।

অধ্যাপক ড. তাহের

তাহের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে এক শিক্ষকসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। পরে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এরা হলেন ড. তাহেরের সহকর্মী একই বিভাগের শিক্ষক ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন এবং ড. তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম।

এ মামলার সন্দেহভাজন অপর আসামি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুবুল আলম সালেহীকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।

অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল আলম

২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির পাশে নিজ বাসভবনের একটু সামনে ধারালো অস্ত্রে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামকে।

রাতে আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামের একটি ফেসবুক পাতায় এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া হয়। উগ্রপন্থী এই সংগঠনটি বাংলাদেশে আইএস-এর মতাদর্শী বলে দাবি করা হয়।

অধ্যাপক শফিউল

২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১১জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এতে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক রেজাউস সাদিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরেই অধ্যাপক শফিউলকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী  

সর্বশেষ শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মহানগরের শালবাগান এলাকায় নিজ বাসার কাছে খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী।

হত্যাকাণ্ডের ধরনের সঙ্গে ব্লগার হত্যার ধরনের মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রতিক্রিয়াশীল চরমপন্থীদের হাতে তিনি নিহত হতে পারেন বলে পুলিশ সন্দেহ করছে।

অধ্যাপক রেজাউল করিমের ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ বাদী হয়ে বোয়ালিয়া থানায়  অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে ‍একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

রাবি অধ্যাপক রেজাউল করিম

তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে জানা গেছে। তবে তিনি সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ‘কোমল গান্ধার’ নামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক একটি পত্রিকা অনিয়মিতভাবে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো। এছাড়া ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।

এভাবে একের পর এক শিক্ষক হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক বাড়ছে। যেকোনও সময় যেকোনও শিক্ষক এ ধরনের হামলার শিকার হতে পারেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আশঙ্কা করছেন।

/এইচকে/টিএন/