ঠাকুরপাড়ায় হামলার পরিকল্পনা নভেম্বরের শুরু থেকে

পুড়িয়ে দেওয়ার ঘরবাড়িরংপুরের হিন্দু অধ্যুষিত ঠাকুরপাড়ায় ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে যে তাণ্ডব চালানো হয় তার পরিকল্পনা শুরু হয় মূলত নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে। সেদিন স্ট্যাটাসটি ছড়িয়ে পড়লে নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে ৩ নভেম্বর শুক্রবার ঘটনাস্থলে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনের আহ্বানকারীরা সেই সমাবেশের ছবি নিজেরাই ফেসবুকে ছেড়ে দেয় এবং যেকোনও মূল্যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া টিটু রায়কে গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবি জানানো হয়। সেই সঙ্গে জনগণকে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এমনটাই জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শী।

তারা আরও জানান, ওই সমাবেশ থেকে ১০ নভেম্বর আবারও মানববন্ধন ও সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই সমাবেশ সফল করতে পাগলাপীর ও পাশের খলেয়া ইউনিয়ন সদর উপজেলার মমিনপুর ও তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়াল কুঠিসহ আশেপাশের সব মসজিদে জুমার নামাজের সময় ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে জেহাদ করার জন্য ফতোয়া দেওয়া হয় এবং সবাইকে মিছিল সমাবেশে যোগদানেরও আহ্বান জানানো হয়।
বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ সকাল থেকে মানববন্ধনের স্থান সলেয়াসার এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখানে জুমার নামাজের পর মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের জেলা সভাপতি বিএনপি নেতা এনামুল হক মাজেদী , মাসুদ রানা , ডাঙ্গিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম সহবেশ কয়েকজন জামায়াত শিবির নেতা। তবে পুলিশ তাদের বেশিক্ষণ মানববন্ধন করতে না দিলেও আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষের ঠাকুরপাড়া মহল্লার দিকে আসতে থাকে। তাদেরকে ঠেকানোর কোনও প্রস্তুতি ছিল না। ১৫/২০ হাজার মানুষ লাঠি হাতে ঠাকুরপাড়া হামলা করতে আসায় এত বেশি মানুষের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারেনি পুলিশ। তবে সকাল থেকেই ঘটনাস্থলের আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা হলে আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে এ তাণ্ডবের ঘটনা ঘটতো না। এটা পুলিশের চরম ব্যর্থতা বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী।

 

ধ্বংসস্তূপএদিকে, এ ঘটনার মূল হোতা ও ইন্ধনদাতাদের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতারা হলেন- জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের জেলা সভাপতি বিএনপি নেতা এনামুল হক মাজেদী , মাসুদ রানা, ডাঙ্গিরহাট কলেজের অধ্যাক্ষ বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম, জেলা পরিষদের প্রকৌশলী ফজলার রহমান খলেয়া, ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর সিরাজুল ইসলাম ও তার ছেলে তারেক, হাড়িয়াল কুঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ভাই পাগলাপীর মসজিদের ইমাম, ইকরচালি, তারাগঞ্জ ও আশপাশের মসজিদের ইমামসহ বেশ কয়েকজন।

পরিকল্পনা ছিল- সলেয়াসা এলাকায় এক পক্ষ মানববন্ধন করবে অন্যদিকে মমিনপুর, হাড়িয়াল কুঠি আর খলেয়ার আশেপাশের লোকজন সরাসরি ঠাকুরবাড়ি গ্রামে হামলা চালাবে। ঘটেছেও তাই। তারা হামলা চালিয়ে ৩০টি বাড়িতে আগুন দিয়েছে মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, ও গুলিবর্ষণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আনার চেষ্টা করলেও কোনও কাজ হয়নি। গুলিবিদ্ধ হয় ১০ জন। এদের মধ্যে হামিদুল নামে একজন নিহত হন। এছাড়া এখনও মৃত্যুর সঙ্গে আইসিইউতে পাঞ্জা লড়ছেন মাহবুব নামে এক যুবক।

ঘটনাস্থল ঠাকুরপাড়া গ্রামতবে পুলিশ বলছে, ইকরচালিতে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরন্নবী দুলালের জানাজার সময় সেখান থেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পরেই জানাজায় শরীক হওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষ ঠাকুরপাড়ায় হামলায় অংশ নেয়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী এবং ওই জানাযার নামাজে অংশ নেওয়া প্রথম আলোর তারাগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি রহিদুল মিয়া দাবি করেছেন, তিনি নিজেই নামাজের সামনে কাতারে ছিলেন, সেখানে উস্কানিমূলক কোনও বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে সেখান থেকে হয়তো কিছু লোক যেতে পারে।

এদিকে, স্বয়ং পুলিশের আইজিপি মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পাশের একটি মাদ্রাসা মাঠে সমাবেশে এ তাণ্ডবের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন।

রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন জানান, মামলার এজাহার নামীয় দুই আসামি জামায়াত নেতা সিরাজুল ইসলাম ও তার ছেলে তারেককে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতার করার অভিযান চলছে। অচিরেই সব আসামি ধরা পড়বে বলে জানান তিনি।