পার্বতীপুরে ১৫০০ বছর আগের গুপ্ত রহস্যের সন্ধান

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে প্রত্নখননে ১৪০০-১৫০০ বছর আগের বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান মিলেছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের বাঁকানো ইট, মৃৎপাত্র, বিভিন্ন মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, বিশেষ মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পাথরের টুকরো, টিসিবল, প্রাণীর হাড় পাওয়া গেছে। 

পার্বতীপুর উপজেলার ৯ নম্বর হামিদপুর ইউনিয়নের ইসবপুর মৌজার ধাপের বাজার এলাকায় প্রত্নখননকাজ চলমান। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অর্থায়নে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর যৌথভাবে খননকাজটি করছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খননকাজ পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক সোহাগ আলী। তিনি বলেন, এখনও খনন, ইতিহাস উন্মোচনসহ যাবতীয় কাজ চলমান। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তা নিয়ে গবেষণা চলছে।

এখানে স্থাপত্যকাঠামো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অস্তিত্ব মিলেছে

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক হান্নান মিয়া খননকাজ উদ্বোধন করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ধাপের বাজার অংশে প্রত্নখননকাজ শুরু হয়। এর আগে ২০১৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেনের তত্ত্বাবধানে একটি দল এই প্রত্নতত্ত্ব স্থান চিহ্নিত করে। 

খনন কার্যক্রম প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে প্রত্নতত্ত্ব স্থানটি ধাপ নামে পরিচিত। ধাপ অর্থ উঁচু স্থান। ধাপের বাজার প্রত্নতত্ত্ব স্থানটিতে প্রত্নখনন যতটুকু সম্পন্ন হয়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে তিনটি নির্মাণ যুগের স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। সবচেয়ে প্রাচীন যে স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেটির ভূমি নকশা ও অন্যান্য উপাদান পর্যালোচনা করে খননকাজ প্রতিনিধি দল এটিকে প্রাচীন মন্দিরবিশিষ্ট বৌদ্ধবিহার বলছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতে যেসব বৌদ্ধ স্থাপনা রয়েছে, তার বেশিরভাগই বৌদ্ধবিহার ও বিহারকেন্দ্রিক মন্দির স্থাপনা। তবে এখানে প্রাপ্ত বৌদ্ধ মন্দিরের ভূমি, নকশা কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও অনেক বৈশিষ্ট্যের মিল আছে। সাধারণত বৌদ্ধ মন্দির কিংবা বিহারগুলো বর্গাকার হয়। চারদিকের বাহুতে ভিক্ষুকক্ষ, ছোট মন্দির থাকে। মাঝখানে ফাঁকা বিহারঙ্গন (কোর্টইয়ার্ড) থাকে।

এখনও খনন, ইতিহাস উন্মোচনসহ যাবতীয় কাজ চলমান

বিহারঙ্গনে মন্দির কিংবা নিবেদন স্তূপ থাকতে পারে। আবার ফাঁকাও থাকতে পারে। এখানে যে স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে তার ভূমি নকশা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্থাপনাটি বর্গাকার। প্রত্যেক বাহু প্রায় ৩৬ মিটার। বর্গাকার স্থাপনার পশ্চিম বাহুর মাঝ বরাবর বাইরের দিকে বর্ধিত একটি আয়তাকার কক্ষ আছে। কক্ষের উত্তর-দক্ষিণে ৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৪.২ মিটার। কক্ষটির দেয়াল প্রায় ১.২ মিটার। কক্ষের পূর্ব পাশে একটি প্রবেশপথ আছে। মাঝে ইটের ছোট টুকরো ও গুঁড়ামিশ্রিত করে মজবুত মেঝে আছে। মেঝের ওপর উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ইট নির্মিত দুটি ছোট প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। কক্ষের সামনে একটি বর্গাকার বিহারঙ্গন রয়েছে। এর প্রত্যেক বাহুর পরিমাণ ২২.৮ মিটার। সম্ভবত বিহারঙ্গনের উত্তর পাশের মন্দিরে মূল প্রবেশপথ ছিল। পুরো বিহারঙ্গনজুড়ে মজবুত মেঝে রয়েছে।

সম্ভবত বিহারঙ্গনের মাঝখানে বর্গাকার আরেকটি অংশ রয়েছে। এখন পর্যন্ত খননের ফলে পশ্চিম বাহুতে তিনটি এবং উত্তর বাহুতে ছয়টি বৌদ্ধ ভিক্ষুকক্ষ পাওয়া গেছে। তবে খননকাজ শেষ হলে প্রায় ২৪টির মতো কক্ষ আবিষ্কৃত হতে পারে। কক্ষগুলো সমান আয়তনের। কক্ষগুলোর বিভাজন দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ০.৯৫ মিটার থেকে ১.২০ মিটার এবং পেছনের দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ২.২০ মিটার। কিন্তু সম্মুখ দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ২.০৪ মিটার। বিহারের ভেতর দিকে একটি ২.৫ মিটার প্রশস্ত একটি টানা বারান্দা আছে। আকার আকৃতি ও স্থাপত্য দিক বিবেচনায় বগুড়ার ভাসু বিহার ও দিনাজপুরের সীতাকোট বিহারের সঙ্গে মিল রয়েছে। দ্বিতীয় নির্মাণ যুগের স্থাপনাটি কি ছিল তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। 

প্রথম স্থাপনাটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর তার ওপর এবং কোথাও কোথাও সেটি ভেঙে তার ওপর নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাচীন স্থাপনার পশ্চিম বাহুতে যে আয়তাকার কক্ষটি ছিল, দ্বিতীয় নির্মাণ যুগে এসে কক্ষের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কক্ষের যে কুলঙ্গি সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর মাটি ফেলে পুরো স্থানটি ভরাট করা হয়েছে। বিহারঙ্গনের মধ্যে মাটি ফেলে একইভাবে উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে বিহারঙ্গনের বিভিন্ন দেয়ালের ওপর নতুনভাবে দেয়াল নির্মাণ করতে দেখা গেছে। তৃতীয় নির্মাণ যুগের যতটুকু প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাতে সাম্প্রতিক সময়ের বলে মনে হয়েছে। সম্ভবত স্থাপনাটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় টিলার (টিবি) ওপর কেউ হয়তো এখানকার ইট ব্যবহার করে স্থাপনা তৈরি করেছিল। 

প্রাথমিকভাবে তিনটি নির্মাণ যুগের স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে

ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক সোহাগ আলী, শাহজাদপুর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান আবু সাইদ ইমাম তানভীরুলের নেতৃত্বে এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের রাজশাহী-রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানার তত্ত্বাবধানে খননকাজ চলছে।

খননকাজের অন্যতম বিশেষজ্ঞ সদস্য হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক একেএম শাহনাওয়াজ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান। 

অন্যান্য সদস্য হলেন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক জেসমিন নাহার ঝুমুর, মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান রাজিয়া সুলতান, দিনাজপুর কান্তজিউ মন্দির প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান ও সিনিয়র ড্রাফটসম্যান আফজাল হোসেন। 

এ ছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১০ জন শিক্ষার্থী, মহাস্থানগড় থেকে আসা আট জন অভিজ্ঞ শ্রমিক ও ১২ জন স্থানীয় শ্রমিক এখানে কাজ করছেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সপ্তম শতকের শেষ দিকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছিলেন। হিউয়েন সাং তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০টির মতো বিহার দেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন। বিহারগুলোতে তিনি শ্রমন কিংবা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসবাস করতে দেখেছেন। কাজেই এটি হিউয়েন সাংয়ের ২০টি বিহারের একটি হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে এটি সীতাকোট বিহারের সমসাময়িক হতে পারে। আবার সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট বিহার ও সংঘারাম নির্মাণ হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটি সোমপুর মহাবিহারের কিছু পরেরও হতে পারে।

খননকাজ প্রতিনিধি দল এটিকে প্রাচীন মন্দির বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিহার বলছে

তবে সময়কাল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন পদ্ধতি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রেডিও কার্বন ডেটিং তার মধ্যে অন্যতম। প্রত্নতত্ত্ব স্থানটির যে ব্যাপ্তি তাতে এখন পর্যন্ত খুব অল্প উন্মোচিত হয়েছে। এখানে আরও অনেক কাজ করার বাকি আছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাটি এখনও চলমান। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি গবেষণা প্রতিনিধি দল।

সম্পূর্ণ গবেষণা শেষ হলে প্রকৃত সময়কাল জানা যাবে। এ ছাড়া স্থাপনার টিলা বিভিন্ন সময় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানে দেয়াল খাড়াভাবে কাটা হয়েছে। কোনও কোনও স্থান থেকে ইটের দেয়াল তুলে নিয়ে গেছে। টিলার দক্ষিণ পাশে দোকানঘর নির্মাণ করে বাজার স্থাপন করা হয়েছে। পূর্ব পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। পশ্চিম পাশ কেটে গভীর গর্ত করে মাটি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপরও টিলার যতটুকু অবশিষ্ট আছে, পর্যাপ্ত বাজেট এবং সময় নিয়ে কাজ করে পুরো স্থাপনা উন্মোচন করতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজিত হবে।

এসব বিষয়ে খননকাজের নেতৃত্বে থাকা প্রভাষক সোহাগ আলী বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাটির সময়কাল সুনির্দিষ্টভাবে এখনই বলা মুশকিল। কারণ এখানকার কোনও নমুনার এখন পর্যন্ত রেডিও কার্বন ডেটিং করা হয়নি। এমন কোনও পরিচিতিমূলক প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়নি, যেটির সাহায্যে সুনির্দিষ্ট সময়কাল বলা সম্ভব। তবে আমরা বিরামপুরের সীতাকোট বিহারের সময়কাল উল্লেখ করেছি। সীতাকোট বিহারের সময়কাল ৫ম-৬ষ্ঠ শতক এবং সোমপুর মহাবিহারের সময়কাল অষ্টম শতক। খনন কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তাতে এটি সীতাকোট বিহারের সমসাময়িক হতে পারে। এর ওপর ভিত্তি করে ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দী বলছি আমরা।