রেড জোন দিনাজপুরে যেসব কারণে বাড়ছে সংক্রমণ

করোনার সংক্রমণ ও শনাক্তের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় দেশের যে ১২টি জেলাকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে, তার অন্যতম দিনাজপুর। রেড জোন ঘোষণা হলেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত, মাস্ক পরছেন না অধিকাংশ মানুষ। গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সচেতনতা একেবারে নেই বললেই চলে। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলায় শনাক্তদের অধিকাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত। ফলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে, যদিও ওমিক্রনে মৃত্যু ঝুঁকি কম। দিনাজপুর ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় সংক্রমণ বেশি বলে মনে করছেন তারা। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সরকারের নির্দেশনাগুলো প্রতিপালনের কথা জানিয়েছে প্রশাসন।

এদিকে, আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করোনা আক্রান্ত ছিল ১০ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪১ জন এবং তৃতীয় সপ্তাহে তা দাঁড়িয়েছে ২০২ জনে। একই সঙ্গে প্রথম সপ্তাহে সক্রিয় রোগী ছিল ২৭ জন, দ্বিতীয় সপ্তাহে ৪৯ জন এবং তৃতীয় সপ্তাহে এসে দাঁড়িয়েছে ২৪০ জনে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আক্রান্ত ও রোগী বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। চতুর্থ সপ্তাহের প্রথম দুই দিনে আক্রান্ত ৭৬ জন আর রোগী ৩০৯ জন।

গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সচেতনতা একেবারে নেই বললেই চলে

গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছেন একজন। একই সময়ে ১৪৯ নমুনা পরীক্ষা করে ৭৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে রোগী ৩৮৩ জন, হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন করোনা পজিটিভ ১৪ জন এবং উপসর্গ নিয়ে ১৪ জন।

এর আগে রবিবার জেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন তিন জন, যেখানে গত এক মাসে জেলায় করোনার উপসর্গ বা করোনার সংক্রমণ নিয়ে কেউ মারা যায়নি। এদিন জেলায় করোনা শনাক্তের হার ৫১ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও অধিকাংশ মানুষ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি, নেই মাস্কের ব্যবহার। গ্রামাঞ্চলের চিত্র আরও ভয়াবহ। যদিও তাদের কাছে রয়েছে নানা যুক্তি। করোনার উপসর্গ দেখা দিলেও করছেন না পরীক্ষা। তবে টিকা নেওয়ায় বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে তাদের।

গোপালগঞ্জ বাজারে মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করা শরিফুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় মাস্ক পরছি না। তবে এখন করোনা বাড়ছে, চিন্তা করছি আবারও মাস্ক ব্যবহার করবো।

অধিকাংশ মানুষ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি, নেই মাস্কের ব্যবহার

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে তো মাস্ক পরতাম। করোনা কমে যাওয়ায় মাস্ক পরছি না। এখন শীত, মাফলার মুখে বেঁধে রাখি। করোনা বেড়ে যাচ্ছে এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আমি করোনার টিকা নিয়েছি।

শাহানুর আলম বলেন, এখন করোনাকে ভয় করি না। আমরা গ্রামের মানুষ, টিকা নিয়েছি। তবে ওমিক্রম আসায় আতঙ্কে আছি। গ্রামে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা হাসপাতালে যাচ্ছেন না। পরীক্ষাও করান না। করোনায় আক্রান্ত কিনা বোঝাও যায় না। এভাবে গ্রামে ছড়াচ্ছে করোনা। 

ভদ্রকালী মোড় এলাকার গোপাল চন্দ্র বলেন, ঠান্ডার কারণে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। করোনা আবারও বাড়ছে। সর্দি, কাশি, জ্বর হচ্ছে। কিন্তু কেউ পরীক্ষা করছেন না। তবে প্রায় সবাই টিকা নিয়েছেন।

মাতাসাগর এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, আমরা কৃষিকাজ করি। করোনাকে ভয় করি না, টিকা নিয়েছি। করোনাকে ভয় করে চললে তো পেটে ভাত জুটবে না।

খলিল উদ্দিন বলেন, জ্বর, সর্দি, কাশিতে যেন আক্রান্ত না হই সেভাবে চলাফেরা করছি। গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ পরীক্ষা করছেন না। আমরা তো আক্রান্ত হলেও বুঝি না। জ্বর, সর্দি হলে ট্যাবলেট খাচ্ছি, তাতেই ভালো হয়ে যাই। আমি টিকা নিয়েছি।

তবে খেটে খাওয়া মানুষের দাবি, করোনায় তারা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। এই অবস্থায় দেশে আর যাতে লকডাউন দেওয়া না হয়। লকডাউন দিলে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

কিসমত ভুইপাড়া এলাকার ভ্যানচালক জুয়েল ইসলাম বলেন, আবারও যদি লকডাউন দেয় তাহলে তো চলাফেরা বন্ধ হয়ে যাবে, আয়-উপার্জন বন্ধ হবে। তখন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

গোপালগঞ্জ তেলিপাড়া এলাকার ভ্যানচালক কায়সার আলী বলেন, এমনিতেই কাজকাম নেই। সারা দিনে একশ-দেড়শ’ টাকা আয় হয়। কীভাবে সংসার চালাবো, হিমশিম খাচ্ছি। টুকটাক করে চলতেছি। দুই বছর ধরে করোনা, কবে যে পালাবে।

দিনাজপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী স্বপন কুমার রায় বলেন, শীতকালে জ্বর, সর্দি ও কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। একই উপসর্গ করোনাভাইরাসেরও। কিন্তু এসব রোগে আক্রান্ত হলেও কেউ পরীক্ষা করছেন না, ফলে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন না। তবে গ্রামের মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী। তারা টিকা নেওয়ার সময়ও মাস্ক পরেন না।

সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ৮ জানুয়ারি থেকে জেলায় ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ ঘোষণা করেছিল জেলা করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধ কমিটি। তবে সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের নির্দেশনাগুলো প্রতিপালন করা হচ্ছে, অভিযান চালানোর কথাও বলছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা

দিনাজপুরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আসিফ আহমেদ হাওলাদার বলেন, আমরা পুরনো পদক্ষেপগুলো মনিটরিং করে সমন্বয় করছি। সংক্রমণ ঠেকাতে মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে বলা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করা, জনসমাগম এড়িয়ে চলাসহ নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে সবাইকে অনুরোধ করছি। 

তিনি বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে ওমিক্রনের প্রভাবটাই বেশি। আমরা যেহেতু সীমান্তঘেঁষা জেলা, তাই এখানে সংক্রমণ বেশি। লোকজন ভারত-বাংলাদেশে চলাচল করছেন। ব্যবসায়ীরা যাওয়া-আসা করছেন। আমদানি-রফতানি পণ্য নিয়ে ট্রাকচালক ও সংশ্লিষ্টরা যাওয়া-আসা করছেন। আমাদের সবকিছুই তো পরিকল্পনা মাফিক হয়নি। কিছু হয়েছে, কিছু হয়নি। তবে ওমিক্রন দ্রুত ছড়াচ্ছে ঠিক কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি কম। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে এটা আমরা পেয়েছি। শনাক্ত হওয়া অধিকাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত। 

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শরিফুল ইসলাম বলেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা আইন প্রয়োগ করছি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে, মাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা প্রতিপালনে কাজ চলছে।