সনদ অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১১ আগস্ট। স্বাধীনতার আগেই বিয়ে হয় এবং তিন সন্তানের বাবাও হন। এরপর ১৯৭১ সালে ৪৩ বছর বয়সে দেশের টানে স্ত্রী-সন্তান ফেলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীনের পর ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। নিয়ম অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম আসে এবং ২০০৮ সাল থেকে ভাতা পেতে শুরু করেন। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ভুল সংশোধনে ২০১৭ সালের আবেদন করেও তিনি কোনও সুরাহা পাননি। এরমধ্যে, ২০২০ সালে অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য হালনাগাদ করতে গিয়ে পড়েন ভোগান্তিতে। বন্ধ হয়ে যায় নিয়মতি সম্মানি। শেষ পর্যন্ত ভাতা বঞ্চিত হওয়ার গ্লানি নিয়ে এ বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী। তবে তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে দাফন করে স্থানীয় প্রশাসন।
জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তার জন্ম তারিখ ভুলে দেওয়া হয়েছে ১৯৭১ সালের ১০ মে। তিনি চর ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ধুলার কুটি গ্রামের মৃত বাবন শেখের ছেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা ১৭ নম্বর বই ৪০১৪৭ ক্রমিক, লাল মুক্তিবার্তায়-৩১৬০৪০৫২০ ক্রমিক এবং ২০০৫ সালের ২১ মে প্রকাশিত বেসামরিক গেজেটের ৩৭৯১ পৃষ্ঠার ১০৬৪ নম্বরে তার নাম রয়েছে।
ভুক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের দাবি, ২০১৭ সাল থেকে জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে ঘুরেও কোনও সুরাহা মিলেনি। শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে সুচিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে মারা যান ৯৪ বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী।
স্বজনরা আরও জানান, আকবর আলীর পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। এর মধ্যে যুদ্ধের আগে তিন সন্তানের জন্ম হয়। এনআইডি অনুযায়ী বড় ছেলে আমির হোসেনের জন্ম তারিখ ১৯৬০ সালের ২ মার্চ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ১৯৭১ সালের ১০ মে। ২০১৭ সালের পর থেকে জন্ম তারিখ সংশোধনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় তার।
ছেলে আমির হোসেন বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় ভুল করে আমার বাবার বয়স দিয়েছে ১৯৭১ সাল। আমাদের ভাই-বোনদের কারও বয়স দিছে ১৯৫০, কারও ১৯৬০। এমন অনেক সমস্যা করেছে। এই জন্ম তারিখ ঠিক করার জন্য যেখানেই গেছি খালি ট্যাহা-ট্যাহা করে। তাও আমগো বাবার জন্ম তারিখ ঠিক হয় নাই। আমরা ব্যর্থ হয়া গেছি গা। শ্যাষ পর্যন্ত বাবা মারাই গেলেন।’
মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেওয়া বলেন, ভাতা বন্ধ হবার কিছুদিন পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসাপাতি ঠিকমতো করতে পারলাম না।
আকবর আলীর নাতি রঞ্জু বলেন, ‘আমার দাদা-দাদি মুর্খ মানুষ, তারা জন্ম তারিখ বোঝেন নাই। কিন্তু ২০০৮ সালে তাদের এনআইডিতে জন্ম তারিখ ভুল তোলা হয়েছে। পরে দাদার বয়স ঠিক করতে আমরা ঢাকা গেছি। সেখানে বলা হয় আমরা পারবো না এটা রংপুর থেকে ঠিক করবে। রংপুরে গেছি সেখানে আমরা পাত্তাই পাই না। বহু টাকা পয়সা খরচ করেও কোন লাভ হয় নাই। দাদা মারাই গেল। তবু এখনও ভাতা চালু হয় নাই। এখন নির্বাচন কমিশনের ভুলের খেসারত আমাদেরকে দিতে হচ্ছে।’
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর মৃত্যুর পর তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে দাফন করা হয়। জন্ম তারিখসহ বিভিন্ন কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অনেকের ভাতা বন্ধ থাকলেও তারাতো মুক্তিযোদ্ধা।’
জেলা নির্বাচন অফিসার জাহাঙ্গীর আলম রাকিব বলেন, “ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদনটি ‘গ’ ক্যাটাগরিভুক্ত। আমি গত ৩ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম তারিখ সংশোধনে কার্ড ম্যানেজমেন্ট (সিএমএস) পোর্টালে তদন্তের নির্দেশনা পাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান। পরে তার মৃত্যু সনদ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আশা করছি দ্রুত তার জন্ম তারিখ সংশোধনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত আসবে।”