‘ধানও পাইলং না, পোয়ালও পাইলং না’

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের বর্গাচাষি নুর ইসলাম। কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কের পাশে শিংগিমারীর দোলায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে এবার ধান আবাদ করেছিলেন। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত ধান কেটে বাড়িতে নিলেও শুকাতে পারেননি। আর জমিতে থাকা খড় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পচন ধরেছে। স্ত্রী বছিরনকে সঙ্গে নিয়ে সেই খড় পানি থেকে ডাঙায় তুলছিলেন নুর ইসলাম।

বছিরন বলেন, ‘ধান কাটি ভাগ দিয়া যেখনা পাছি তাও নষ্ট হবার ধরছে। বেশির ভাগত গাছ জালাইছে (অঙ্কুর গজিয়েছে)। পোয়াল (খড়) বেচেয়া যদিওবা কয়টা ট্যাকা পাইলং হয়, তাও পচি যাবার নাগচে। এবার কী খায়া থাকমো সেটায় চিন্তা নাগাচি। রোগা মানুষটা (নুর ইসলাম) কামও করবার পায় না।’

আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বাড়ছে নদ-নদীর পানি, বন্যার আশঙ্কা

নুর ইসলাম বলেন, ‘কী করমো, কপাল খারাপ। কিছু ধান জমিতে নষ্ট হইছে। যেগুলা বাড়িত নিয়া গেছি তারও গাছ বেড়াইছে। ধানও পাইলং (পেলাম) না, পোয়ালও পাইলং না।’

ধান আর খড় নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কুড়িগ্রামের কৃষকরা

শুধু নুর ইসলাম-বছিরন দম্পতি নয়, জেলার বেশিরভাগ কৃষক পরিবারে চলছে নীরব মাতম। কষ্ট করে ফলানো ফসল ঘরে তোলার আগ মুহূর্তে বৈরি আবহাওয়া তাদেরকে দিশেহারা করে দিয়েছে। শুধু ভাত নয়, এই ধান বিক্রি করে তাদের সংসারের যাবতীয় চাহিদা মেটাতে হয়। সেখানে দ্রব্যমূল্যের চড়া বাজারে সামনের দিনগুলোতে তারা পরিবার নিয়ে কীভাবে টিকে থাকবেন, সে চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভুক্তভোগী কৃষকদের।

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলমান বৃষ্টি ও বৈরি আবহাওয়ায় বোরো ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। জলাবদ্ধতায় ধান ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় ক্ষেত থেকে কেটে নিলেও বিড়ম্বনা পিছু ছাড়েনি। বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশে রোদের অভাবে ঘরে তোলা ধানে অঙ্কুর গজাতে শুরু করেছে। আর স্তূপকৃত খড়ে ধরেছে পচন। ধান আর খড় নিয়ে উভয় সংকটে কৃষকরা। 

জেলা সদরের ঘোগাদগ ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষক মামুন জানান, তার নিজের আবাদ করা ১৮-২০ মণ ধানে অঙ্কুর বের হয়েছে। রোদের অভাবে শুকাতে পারছেন না। খড়ের আশা ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। তার এলাকার বেশিরভাগ কৃষকের একই অবস্থা।

মামুন বলেন, ‘যারা ব্রি-২৮ ধান কিংবা হাইব্রিড লাগিয়েছেন, তারা কেটে নিতে পারলেও মাড়াই করে শুকাতে পারছেন না। ঘরে রাখা ধানে অঙ্কুর বেরুচ্ছে, ধানের রঙও নষ্ট হয়ে গেছে। আর যারা ব্রি-২৯ লাগিয়েছেন তাদের ধান অপরিপক্ক থাকায় জমিতেই জলাবদ্ধতায় নষ্ট হওয়ার পথে। অনেকের নষ্টও হয়েছে।’

জেলার প্রত্যেক এলাকায় গ্রামীণ সড়কসহ পাকা সড়কের ধারে খড়ের স্তূপ। অনেক স্থানে জমির পানিতে পরে আছে খড়। থেমে থেমে বৃষ্টিতে ধান কিংবা খড় শুকানোর ফুরসত মিলছে না কোথাও। মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরিতে ধান শুকাতে নিয়েও তড়িঘড়ি করে ঘরে তুলতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক পরিবারের সদস্যরা।

স্তূপকৃত খড়ে পচন ধরেছে

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামারবাড়ি) তথ্যমতে, কুড়িগ্রামে এবার এক লাখ ১৬ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এর আগে আকস্মিক ঢলে জেলার নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২৭৬ হেক্টর বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন ধরা হলেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সেটা অর্জন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

জেলাজুড়ে ধান নিয়ে কৃষকদের হাহাকার চললেও তাতে চালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনও প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন খামারবাড়ির উপ-পরিচালক (ডিডি) আব্দুর রশীদ। তিনি বলেন,‘ কতটুকু আর ধান নষ্ট হয়েছে? বেশিরভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে।’

কেটে নেওয়া ধান মাড়াই করে কৃষকরা শুকাতে পারছেন না, গোলায় তুলতে পারছেন না। অনেকের ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এমন তথ্যে আব্দুর রশীদ বলেন, ‘সেটা আমরা যখন চূড়ান্ত হিসাব করবো তখন বলা যাবে। এখন আর কথা বলতে পারবো না।’