পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫০ মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। অতীতে এমন নৌকাডুবি ও একসঙ্গে এত মানুষের প্রাণহানি দেখেনি পঞ্চগড়বাসী। তাহলে এত বড় দুর্ঘটনার দায় কার? দায়িত্বশীলদের ভূমিকা কী ছিল? করতোয়ার আউলিয়ার ঘাটে গিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধি।
এই নৌকাডুবির ঘটনায় প্রতিনিধির সঙ্গে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর কথা হয়। তারা বলছেন, পর্যাপ্ত নৌকার অভাব, অব্যবস্থাপনা আর ইজারাদারের খামখেয়ালির পাশাপাশি পুণ্যার্থীদের সচেতনতার অভাবেই এই ভয়াবহ নৌকাডুবি আর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অথচ একটু সতর্ক থাকলেই এত প্রাণ রক্ষা করা যেতো।
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় দিনের অভিযান স্থগিত, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫০
আউলিয়ার ঘাট ও এর আশপাশে নিয়মিত নৌকা নিয়ে বিচরণ করেন সুমন দাস। তিনি বলেন, ‘এই ঘাটে প্রতিদিন একটি নৌকায় লোক পারাপার করা হয়। যে নৌকা ডুবেছে সেটিই যাতায়াত করে। মহালয়ার পূজায় ওপারে বদেশ্বরী মন্দিরে যাতায়াতের জন্য ওই দিন দুটি নৌকা দেওয়া হয়। এরমধ্যে আবার একটা ছোট ছিল। কিন্তু এত লোকের চাপ ছিল যে ওই নৌকায় মানুষের জায়গা হইতেছিল না। ঘাটে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন, গ্রাম পুলিশ সবাই ছিল। তারা মাইকে বারবার অতিরিক্ত মানুষ উঠতে নিষেধও করছিল। কিন্তু মানুষের চাপ সামাল দেওয়া যায় নাই। নৌকায় শতাধিক লোক উঠছিল। যখন অতিরিক্ত মানুষ উঠেছে তখন নৌকা ঘাটেই ডুবু ডুবু ছিল। এরপরও ওই অবস্থায় নৌকা ছেড়ে দেওয়ায় এ ঘটনা ঘটছে। অথচ ওই দিন তিন চারটা নৌকা দিলে এত মানুষ ডুবে মরে না।”
আরও পড়ুন: ‘মা ফিরেছে লাশ হয়ে, বাবা তো ফিরলো না’
ঘাটে দায়িত্ব পালন করা মতিয়ার নামে এক পুলিশ সদস্যের বরাত দিয়ে মিনারুল নামে আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘যে অবস্থার কথা শুনেছি তাতে ইজারাদার যদি চারটা নৌকা দিতো তাহলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো।’
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে করতোয়ার তীরে ছিলেন মাড়েয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মশিয়ার রহমান। তিনি বলেন, এত বড় আয়োজনে ইজারাদারের কোনও সতর্কতা কিংবা প্রস্তুতি ছিল না। মহালয়া উপলক্ষে মানুষের চাপ হবে, এটা সবার জানা। কিন্তু চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁশের ব্যারিকেডের ব্যবস্থা ছিল না। আবার এত মানুষের জন্য বড় নৌকা ছিল মাত্র একটি। ওই নৌকায় মাড়েয়া ইউপি চেয়ারম্যানও উঠেছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে তিনি পরে নেমে যান।
আরও পড়ুন: ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী ছিল নৌকায়, নদীর পাড়ে আহাজারি
এই ইউপি সদস্য আরও বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে বদেশ্বরী মন্দির কমিটিরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তারা জানতো এদিন মানুষের চাপ বাড়বে। তারা ইজারাদার বা প্রশাসনকে নৌকা বাড়াতে বলতে পারতো।
অখিল রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা (ইজারাদার) জানেন যে প্রতিবছর এই সময় ঘাটে প্রচণ্ড ভিড় হয়। কিন্তু ভিড় সামলানোর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার ফলাফল এত প্রাণহানি।’
আরও পড়ুন: দেড় মাস আগে বিয়ে, করতোয়ায় বিচ্ছেদ
প্রত্যক্ষদর্শী শাহীন ও ইউপি সদস্য মশিয়ার রহমান বলেন, নৌকা ছাড়ার আগেই ডুবুডুবু ছিল। তখন ওই অবস্থায় নৌকার মাঝিকে ওপারে যেতে নিষেধ করেন দায়িত্বরত পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। কিন্তু এরপরও মাঝি নৌকা নিয়ে নদীর মাঝামাঝি পৌঁছে যায়। তখন নৌকা এদিক-ওদিক টলছিল। এ সময় মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে আবার ঘাটে ফেরার চেষ্টা করেন। নৌকাটি জোরে ঘোরাতে গিয়ে একদিকে কাত হয়ে উল্টে যায়। মানুষের ওপর মানুষ পড়ে গিয়ে বেশিরভাগ ডুবে যায়। অনেকে সাঁতরে নদীর তীরে ওঠে।
ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া তথ্যমতে, আউলিয়ার ঘাট পঞ্চগড় জেলা পরিষদের অধীন ইজারা দেওয়া হয়। ঘাটটির বর্তমান ইজারাদার আব্দুল জব্বার। তিনি জেলার বোদা উপজেলার কুমারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। দুর্ঘটনার বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: নৌকাডুবির দায় কার?
অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ মোকাবিলায় ঘাট ব্যবস্থাপনায় ইজারাদারের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা, এমন প্রশ্নে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ‘আমরা ইজারাদারকে খুঁজে পাচ্ছি না। সম্ভবত তিনি পলাতক। সবদিক খতিয়ে দেখে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে যাত্রীদের অসচেতনতার কারণে এমন দুর্ঘটনা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।’
পঞ্চগড় জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ সানিউল কাদের বলেন, জেলা পরিষদ খেয়াঘাটের ইজারা দিলেও নৌযানের তদারকি ও যাত্রী পারাপারের বিষয় দেখে স্থানীয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে ইজারাদারের কোনও গাফিলতি থাকলে জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটির তদন্তে সেটা বেরিয়ে আসবে। তখন ইজারাদারের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।