সিআইডি কর্মকর্তার বাসায় শিশুকে নির্যাতনের অভিযোগ

দিনাজপুরে কর্মরত সিআইডি কর্মকর্তা নুরুল আমিনের স্ত্রী আশা বেগমের বিরুদ্ধে শিশু (১২) গৃহপরিচারিকাকে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিত শিশুটি তিন দিন ধরে সাদুল্লাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আছে।

শিশুর স্বজনরা অভিযোগ করেন, পান থেকে চুন খসলেই মারধরসহ শিশুটির ওপর নির্যাতন চালাতো আশা বেগম। শুধু তা-ই নয়, আশা বেগমের শিশু সন্তানের সঙ্গে বিছানায় ঘুমানোর অপরাধে মারধর করা হয় শিশুকে। একপর্যায়ে গলায় সুচ দিয়ে আঘাত ও কয়েলের আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয় ডান হাতে। এ ছাড়া দুই হাঁটুর নিচে ও ওপরে আঘাত করাসহ তার একটি দাঁতও ভেঙে দেওয়া হয়।

গত বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নির্যাতনের শিকার শিশুর বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নে। সে ওই এলাকার এক দিনমজুরের মেয়ে।

সরেজমিনে হাসপাতালে দেখা যায়, চিকিৎসাধীন শিশুর শরীরে নির্যাতনের আঘাত আর অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তার চোখমুখজুড়ে ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে জানায়, বাসার সব কাজ করাতো গৃহকর্ত্রী আশা। কাজ করতে না পারলে বা কোনও ভুল হলে হাতের কাছে যা পেতো তা দিয়ে মারধর করতো। মারধরের সময় কান্নাকাটি করলে মুখ চেপে ধরতো। এভাবে প্রায়ই মারধর করতো।

ভর্তির পর গত তিন দিন শিশুটিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সাদুল্লাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত সিনিয়র নার্স ইসমত আরা ইভা।

তিনি বলেন, ‘শিশুটির অবস্থা গুরুতর। তার গলায় আঘাতের চিহ্ন আছে। দুই পায়ের হাঁটুর নিচ ও ওপরে আঘাতসহ একটি দাঁতও ভাঙা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ডান হাতে কয়েলের আগুন দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ার দাগ আছে, যাতে ফোসকা পড়েছে। এ অবস্থায় শিশুটি শুধু শারীরিকভাবে না, ভয় আর আতঙ্কে মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’

হাসপাতালে শিশুর সঙ্গে থাকা তার নানি জানান, তাদের পাশের গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন নামে এক সিআইডি কর্মকর্তা দিনাজপুরে চাকরি করেন। তিনি বাসায় কাজ করার কথা বলে বোনজামাইয়ের মাধ্যমে ৯ মাস আগে তার নাতনিকে নিয়ে যান। এরপর তার স্ত্রী আশা বেগম নানা সময় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাকে মারধর করতো। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে তার নাতনির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত তৈরি হয়েছে।

শিশুর নানা বলেন, ‘কোনও ভুল হলেই তাকে (শিশু) মারধর করতো আশা বেগম। এক সপ্তাহ আগে আশা বেগমের ছোট শিশু সন্তানের সঙ্গে ঘুমাতে যায় সে। পরে শিশুর পাশে ঘুমানোর অপরাধে তাকে মারধর শুরু করে আশা বেগম। একপর্যায়ে সে কয়েলের আগুন দিয়ে তার ডান হাতে ছ্যাঁকা দেয় এবং মুখে আঘাত করায় একটি দাত ভেঙে যায়। এ ছাড়া তার দুই পা ও ঘাড়েও লাঠি দিয়ে আঘাত করে আশা বেগম।’

তিনি আরও বলেন, ‘মারধর ও কয়েলের আগুনের ছ্যাঁকায় আমার নাতনি অসুস্থ হয়ে পড়ে। গত ১৩ অক্টোবর নুরুল আমিন দম্পতি তাকে নিয়ে এলাকায় একটি বিয়ের দাওয়াতে আসে। পরে সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে তার নানি ও ফুপু দেখা করে। এ সময় সে তাদের নির্যাতনের ঘটনা খুলে বলে। বিষয়টি জানাজানি হলে তাৎক্ষণিক তাকে তার ফুপুর হাতে তুলে দিয়ে কেটে পড়ে সিআইডি কর্মকর্তা নুরুল আমিন।’

তিনি বলেন, ‘১৩ অক্টোবর রাতেই ঘটনাটি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে জানিয়ে বিচার দাবি করি। পরে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম তার পরিষদে সালিস বৈঠক করেন। সালিসে অভিযুক্ত সিআইডি কর্মকর্তা নুরুল আমিনের শ্বশুরসহ তাদের পক্ষের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আমার নাতনির চিকিৎসা ও বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকায় আপসের সিদ্ধান্ত দেন চেয়ারম্যান। সালিসের রায় মেনে নিয়ে রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’

এ নিয়ে প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শিশুর পরিবার হতদরিদ্র। পাঁচ বছর বয়সে তাকে রেখে তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন। তাই ৯ মাস আগে তাকে গৃহপরিচারিকার কাজে পাঠানো হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহ আলম ও জামিল মিয়া বলেন, সিআইডি কর্মকর্তা নুরুল আমিন একজন আইনের লোক হয়েও তার স্ত্রী শিশুর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাতো। তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। এমনকি এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ না নিতে শিশুর নানাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। অমানবিক এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ অভিযুক্ত নুরুল আমিন দম্পতির কঠোর শাস্তির দাবি করেন তারা।
 
এদিকে সালিসে ঘটনাটি আপসরফার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম।

মুঠোফোনে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর পরিষদ ভবনে ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়দের উপস্থিতিতে আলোচনায় বসা হয়েছিল। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবার পাঁচ লাখ টাকা দাবি করায় ঘটনাটি সমাধান করা সম্ভব হয়নি। পরে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করাসহ আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে থাকা স্বজনদের পরামর্শ দিয়েছি।’

অভিযোগের বিষয় জানতে অভিযুক্ত সিআইডি কর্মকর্তা নুরুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি বারবার ফোন করলেও তার ব্যবহৃত মুঠফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় তার বড় ভাই নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিশুটিকে মারধর ও ছ্যাঁকা দেওয়ার ঘটনা সঠিক নয়। তাকে কেউ নির্যাতন করেনি। শারীরিকভাবে সে অসুস্থ হওয়ায় তার ভাই নুরুল আমিন বাড়িতে এসে তাকে তার ফুপুর হাতে তুলে দেন। এ সময় চিকিৎসা বাবদ তার পরিবারকে নগদ কিছু টাকাও দেওয়ার কথা জানান তিনি।

সাদুল্লাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনাটি লোকমুখে শুনেছি। এ বিষয়ে কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। তবে ঘটনাটি যেহেতু দিনাজপুরে ঘটেছে, তাই মামলা করলে সেখানেই করতে হবে। এই মামলা সাদুল্লাপুর থানায় করার সুযোগ নেই।’