সড়ক নেই, ভবন নেই, ধানক্ষেতে সরকারি বিদ্যালয়

চারদিকে কৃষিজমি। জমিতে ধানের চারা লাগিয়ে তাতে পানি সেচও দেওয়া হয়েছে। সেসব জমির মাঝখানে কয়েকটি খুঁটির ওপর দাঁড়ানো একটি টিনের চাল। তাতে বেড়া, দরজা কিংবা জানালা কিছুই নেই। পাশ দিয়ে চলে গেছে সেচের নালা। টিনের চালার সামনে কৃষিজমিতেই বাঁশের মধ্যে লাগানো জাতীয় পতাকা উড়ছে। জমির আইল ধরে সামনে এগোতেই চালার সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ‘উত্তর মাঝের চর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সড়ক নেই, অবকাঠামো নেই, তবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

কল্পনা কিংবা ছবির মতো মনে হলেও এটিই বাস্তব। কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তর মাঝের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। 

মঙ্গলবার বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, দুটি ভাঙা বেঞ্চ আর কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার। চালার নিচে টেবিলের ওপর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হাজিরা খাতা। সেখানে দু’একজন অভিভাবকসহ বসে আছেন শিক্ষকরা। নেই কোনও শিক্ষার্থীর কোলাহল কিংবা শিক্ষকদের পাঠদানের ব্যস্ততা। কাগজ-কলমে বিদ্যালয়ে ৮০ জন শিক্ষার্থী আর পাঁচ শিক্ষক থাকলেও বাস্তবে শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। বছরের এক মাস চলে গেলেও পাঠদান শুরু হয়নি।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, মোগলবাসা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর মৌজায় ২০০৪ সালে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তর মাঝের চর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু বিদ্যালয়ের স্থানটি নিচু হওয়ায় বন্যার পানিতে ডুবে থাকতো। ২০১১ সালে উত্তর মাঝের চর গ্রামে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় বিদ্যালয়টি। সেখানে থাকাকালীন ২০১৮ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। গত বছরের বন্যায় একই ইউনিয়নের চর কৃষ্ণপুর গ্রামের চর কৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ধরলার ভাঙনের শিকার হয়ে উত্তর মাঝের চর গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। 

সড়ক নেই, অবকাঠামো নেই, তবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

একই গ্রামে দুটি বিদ্যালয়ের কাছাকাছি অবস্থান হওয়ায় উত্তর মাঝের চর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে পূর্বের স্থানে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ফলে চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যালয়টি আবারও কৃষ্ণপুর গ্রামে নেওয়া হয়। সেই থেকে অবকাঠামো আর যাতায়াতের সড়কের অভাবে বিদ্যালয়টিতে কোনও শিক্ষার্থী উপস্থিত হচ্ছে না। শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি না থাকায় এ বছর পাঠ কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি বলে জানান শিক্ষকরা।

স্থানীয় অভিভাবক লাইলী বেগম বলেন, ‘সরকারি স্কুল হলেও এখানে ঘর, বেঞ্চ, টিউবওয়েল, ওয়াশরুম এমনকি স্কুলে যাতায়াতের রাস্তা নেই। ভরা শীতে এমন পরিবেশে আমরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাই না। তবে শিশুরা স্কুলে যেতে না পারায় ক্ষতি হচ্ছে।’ দ্রুত বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর দাবি জানান এই অভিভাবক।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘গত বছর পর্যন্ত বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পুরোদমে চালু ছিল। কিন্তু এ বছর জানুয়ারি মাসে আবার স্থানান্তরিত হওয়ায় অবকাঠামো আর যাতায়াত সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে না। অভিভাবকরা নিরাপত্তার অভাবে সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। ফলে নতুন বছরে এখনও পাঠদান শুরু হয়নি।’

ভবন ও অবকাঠামোর প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য দাতা ৩৩ শতক জমি দিয়েছেন। সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) স্থানীয় কর্তৃপক্ষ স্থানটি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু তারা জানিয়েছেন, জমির কাগজে সমস্যা আছে। এজন্য ভবন নির্মাণ দেরি হচ্ছে। অথচ একটি ভবন হলেই শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে এসে পড়াশোনা করতে পারতো।’

জমিদাতা ও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘আমি একবিঘা জমি দান করেছি বিদ্যালয়ের নামে। এখন জমি সংক্রান্ত কি জটিলতা হয়েছে, তারাই ভালো জানেন।’

কৃষ্ণপুর গ্রামে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তর মাঝের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

বছরের এক মাস পার হলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও পাঠদান শুরুর উদ্যোগ নিয়ে উদাসীন সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান। বিদ্যালয়ের ভবন না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভবন বরাদ্দ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।’

তবে পাঠদান শুরু করার প্রশ্নের সদুত্তর দেননি এই শিক্ষা কর্মকর্তা। শিক্ষার্থী উপস্থিতি এবং পাঠদান কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। পরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেদুল হাসান বলেন, ‘ওই বিদ্যালয়ের কার্যক্রমের বিষয়ে আমি অবগত নই। শিক্ষা কর্মকর্তা এবং প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’