X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়

আবদুল্লাহ আল মারুফ, কুমিল্লা
০৯ মে ২০২৫, ০৮:০১আপডেট : ০৯ মে ২০২৫, ০৮:০১

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়ারা ইউনিয়নের যশপুর গ্রামের যশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে মাত্র পাঁচ জন। আর এই পাঁচ শিক্ষার্থীকে পাঠদানের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োজিত রয়েছেন তিন জন শিক্ষক। পাঁচ শিক্ষার্থী আর তিন শিক্ষক দিয়েই চলছে এই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।

বুধবার (০৭ মে) দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ে তিন শিক্ষক উপস্থিত আছেন। সঙ্গে উপস্থিত আছে পাঁচ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে একজন, প্রথম শ্রেণিতে দুজন ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে দুজন। আর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে কোনও শিক্ষার্থী নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪০ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক বছর আগেও অনেক শিক্ষার্থী ছিল। এখন শিক্ষার্থীদের এ বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। অনেকে ভর্তি হলেও পরে অন্য বিদ্যালয়ে চলে যায়।

সরেজমিনে বুধবার দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় ভবনের শ্রেণিকক্ষগুলো ফাঁকা। বারান্দায় বসে আছে পাঁচ শিশু শিক্ষার্থী। তাদের মাঝে বসে আছেন সহকারী শিক্ষক জাকির হোসেন। এর মধ্যে এক শ্রেণিকক্ষের ভেতরে যেতেই চোখে পড়ে এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের খেলার সরঞ্জাম। তবে এ সময় প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে শিক্ষক জাকির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক কিছুক্ষণ আগে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ডাকা মিটিংয়ে গেছেন। এজন্য আসেননি। তবে বিদ্যালয়ে আসবেন বলে জানিয়েছেন। আমাদের বিদ্যালয়ে অনেকদিন ধরেই শিক্ষার্থী কম। যারা আছে তাদের ঠিকমতো পড়ানো হয়।’

সহকারী শিক্ষক মানছুরা আক্তার চৌধুরী বলেন, ‌‘বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ আমরা তিন জন আছি। ২০২০ সালে আমাকে এখানে পোস্টিং দেওয়া হয়। আগে যে বিদ্যালয়ে ছিলাম, সেখানে শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ৫০০ জন। এখানে এসে দেখি শিক্ষার্থী নেই। করোনা মহামারির ওই সময় এক শিক্ষার্থী ছিল। এরপর এলাকা এলাকা ঘুরে ১৭ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়েছি। কিন্তু কেউ এখানে থাকতে চায় না। ভর্তির কয়েক মাস পর চলে যায়।’

কেন শিক্ষার্থীরা থাকতে চায় না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের সামনে একটি মাদ্রাসা আছে। বিদ্যালয়ে আসার কোনও রাস্তা নেই। মাদ্রাসার ভেতর দিয়ে আসতে হয়। কয়েকদিন শিক্ষার্থীরা আসলেও পরে আর আসে না। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি কোনও মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে গেছে। অনেকে আবার কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়েছে। এখানে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। এলাকায় কিছু কুসংস্কার রয়েছে। অনেক অভিভাবক আগ্রহ নিয়ে শিশুদের ভর্তি করান। কয়েকদিন পরে এসে বলেন, স্কুলে পড়ালে নাকি জাহান্নামি হতে হবে। এজন্য সন্তানকে এখান নিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন।’

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিদ্যালয়ে এসে উপস্থিত হন সহকারী প্রধান শিক্ষক (প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ফাতেহা বেগম। রোদে হেঁটে এসে তিনি হাতপাখা নিয়ে নিজ কক্ষে বসে বাতাস করছিলেন।

শিক্ষার্থী কম কেন জানতে চাইলে ফাতেহা বেগম বলেন, ‘অনেকদিন ধরে এই অবস্থায় চলছে। গত দুই বছর বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। এক মাস আগে পানির মোটর চুরি হয়ে গেছে। টিউবওয়েয়ের ভেতরে স্থানীয় কিশোররা আড্ডা দিতে এসে পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এজন্য টিউবওয়েল আর বসানো হয়নি। পানির ব্যবস্থা না থাকায় বিদ্যালয়ের দুটি শৌচাগার অচল। যে কারণে স্থানীয়দের বাড়িতে শৌচাগারে যেতে হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। এ অবস্থায় চলছে বিদ্যালয়। এগুলোর প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর।’

বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগের কথা। কয়েকদিন পর পর চোর এসে বিদ্যুতের ক্যাবলগুলো চুরি করে নিয়ে যেতো। আমরা বিদ্যুৎ অফিসে জানালে তারা ঠিক করে দিয়ে যেতো। একটা সময় বিরক্ত হয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ সংযোগ আর দেয়নি। তবে আমরা আবার আবেদন করেছি। তারা বলেছে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এখনও দেয়নি।’

ফাতেহা বেগম বলেন, ‘বিদ্যালয়টিতে যেন অভিশাপ লেগেছে। কোনও উন্নতি দেখছি না। ২০১৯ সাল থেকে এখানে আছি। শুনেছি আগেও একই অবস্থা ছিল। এখানকার মানুষ চায় না বিদ্যালয়টি এখানে থাকুক। কারণ আশপাশের চার গ্রাম ঘুরেও কোনও শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে পারি না। কিছু কুসংস্কার আছে।’

ফাতেহা বেগম আরও বলেন, ‘বিদ্যালয়ে কোনও নিরাপত্তা নেই। প্রধান ফটকের গেটের একটি অংশ চুরি হয়ে গেছে। পরে আরেকটি অংশ সংরক্ষণ করেছি। এখন গেট নেই। ভেতরের জিনিসপত্র কয়েকদিন পর পর চুরি হয়। অনেক সময় এসে দেখি, শ্রেণিকক্ষের তালার ভেতরে শলা ও ময়লা ঢুকিয়ে নষ্ট করে রেখে গেছে কেউ। আবার জানালার গ্রিল কেটে নিয়ে যায়। জাতীয় পতাকা টাঙানোর স্ট্যান্ডের দড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেছে অনেকবার। এসব নিয়ে দুবার জিডি করেছি থানায়। পুলিশ এসে দেখে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৪০ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তার সামনে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যে কারণে বিদ্যালয়ে আসতে হয় মাদ্রাসা ডিঙিয়ে। সড়ক না থাকায় শিক্ষার্থীরা কয়েকদিন এসে পরে আর আসে না। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ওই মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামীম ইকবাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি। আমরা স্থানীয়দের নিয়ে বসবো। কিভাবে শিক্ষার্থী বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা করবো।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদ্যালয়টির বেহাল দশার কথা আমি জানি। শিক্ষকরা কী পরিমাণ পরিশ্রম করেন, তাও জানি। একাধিকবার বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছি। স্থানীয়দের সঙ্গে উঠান বৈঠক করেছি। এরপরও অভিভাবকরা কোনও সাড়া দেননি। মাদ্রাসার একটি প্রভাব সেখানে আছে। তা সবাই বলেছেন। শিক্ষকরাও বলেছেন। তাই বিদ্যালয়ের জন্য বিকল্প সড়ক করার একটি বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছি। বিদ্যালয়টির প্রতি আমাদের আলাদা নজর আছে। দেখি কী করা যায়।’

/এএম/
সম্পর্কিত
পারভেজ হত্যা মামলায় ৩ দিনের রিমান্ডে টিনা
বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব, প্রধান শিক্ষকের চেয়ার ঝুলছে গাছে
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলনে যুক্ত হলেন শিক্ষকরাও
সর্বশেষ খবর
সাবেক মেয়র আইভী কাশিমপুর কারাগারে
সাবেক মেয়র আইভী কাশিমপুর কারাগারে
মাদ্রাসা সহকারী শিক্ষকদের ৮ম গ্রেডে বেতন দেওয়ার দাবি
মাদ্রাসা সহকারী শিক্ষকদের ৮ম গ্রেডে বেতন দেওয়ার দাবি
তৃতীয় দিনের মতো সংঘর্ষে জড়ালো ভারত-পাকিস্তান, সীমান্তজুড়ে যুদ্ধাবস্থা
তৃতীয় দিনের মতো সংঘর্ষে জড়ালো ভারত-পাকিস্তান, সীমান্তজুড়ে যুদ্ধাবস্থা
হাজারীবাগে যুবকের মরদেহ উদ্ধার
হাজারীবাগে যুবকের মরদেহ উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ৫৬ জনের পদত্যাগ, তুলেছেন দুর্নীতির অভিযোগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ৫৬ জনের পদত্যাগ, তুলেছেন দুর্নীতির অভিযোগ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান