ছুটি না নিয়ে ৪ বছর ধরে জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

ছুটি না নিয়ে চার বছর ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে জাপানে অবস্থান করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রভাষক মাশরেকি মুস্তারি। তিনি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম। এ অবস্থায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রবিবার (১০ ডিসেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আলমগীর চৌধুরী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন মাশরেকি মুস্তারি। কিন্তু শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে না এসে তৎকালীন উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর ‘লিয়াজোঁ অফিস’ ঢাকায় যোগ দেন। সেখানে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের নামে প্রায় এক বছর অবস্থান করেন। এ অবস্থায় শিক্ষক সংকটে লোকপ্রশাসন বিভাগে সেশনজট প্রকোপ আকার ধারণ করলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বিভাগে এসে ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের দুই-তিনটি ক্লাস নিয়ে আবারও ঢাকায় এসে অবস্থান নেন মুস্তারি।

বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর থেকে বিভাগের কোনও ব্যাচের ক্লাস নেননি এবং বিভাগের কোনও সভায় অনলাইনে কিংবা সশরীরে উপস্থিত হননি এই শিক্ষক। এমনকি কোনও ধরনের ছুটিও নেননি। বিধিবহির্ভূতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন-ভাতা নিয়েছেন। এরই মধ্যে জাপানে চলে যান। দেশের বাইরে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের নামে কয়েক দফায় ৮৯ দিনের ছুটি নেন। এরপর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই বছরের পর বছর দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন বিধিবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণ জানতে চেয়ে ওই শিক্ষককে নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর জবাব দেননি তিনি। নোটিশের জবাব যথাযথ না হওয়ায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এখনও প্রতিবেদন দেয়নি। এই শিক্ষক বর্তমানে কী করছেন, কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কিছুই জানেন না বিভাগীয় প্রধান। তবে একাধিক নোটিশ দিয়েও জবাব না পাওয়ায় ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে তার বেতন-ভাতা বন্ধ রেখেছে প্রশাসন।

বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলছেন, পিএইচডি করার কথা বলে প্রভাষক মাশরেকি মুস্তারি জাপানে রয়েছেন। তবে এটি সত্য নাকি মিথ্যা তা আমাদের জানা নেই। বিভাগে শিক্ষক সংকট আছে। এর মধ্যে যদি কোনও শিক্ষক অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে আমাদের কোর্সগুলো শেষ করতে বাকি শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হয়। ছুটি না নিয়ে বছরের পর বছর ওই শিক্ষকের বিদেশে থাকা আমাদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।

প্রভাষক মাশরেকি মুস্তারি কোথায় আছেন, তা জানা নেই বলে উল্লেখ করেছেন লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রধান আসাদুজ্জামান মন্ডল। তিনি বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার তাকে ফেসবুক ও মেইলে বলেছি, শিক্ষক সংকট আছে, আপনি চলে আসেন। কিন্তু তিনি আসেননি। কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তার জবাব দেননি। এরপর কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভাগ থেকে মতামত চাইলে আমরা মতামত দিয়েছি যে, তিনি ২০১৯ সাল থেকে বিভাগে অনুপস্থিত। এই ব্যাপারটি দ্রুত সুরাহা করা দরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’ 

লোকপ্রশাসন বিভাগটি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আওতাধীন। এই অনুষদের ডিন ড. মোরশেদ উল আলম। তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রথমত এটি একটি প্রশাসনিক বিষয়। দ্বিতীয়ত এ বিষয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে এখন পর্যন্ত আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমি এখানে নতুন ডিন হয়েছি। ইতোপূর্বে যিনি এই দায়িত্বে ছিলেন হয়তো তাকে জানানো হয়েছে। তাও আমি সঠিক জানি না। লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে যদি এই বিষয়ে আমাকে জানানো হয়, তাহলে পরবর্তীতে আমি তা প্রশাসনকে জানিয়ে ব্যবস্থা নেবো।’

ছুটি ছাড়াই চার বছরের বেশি কর্মস্থলে অনুপস্থিত কোন শিক্ষক নৈতিকভাবে শিক্ষকতা করার যোগ্য কিনা এমন প্রশ্নের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি এখন তদন্তাধীন আছে। আমরা চাই বিষয়টির দ্রুত সমাধান হোক। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’ 

একই কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আলমগীর চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক বিষয়, সেহেতু তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো আমরা।’

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’