মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

এক জেলায় শিশুদের দুই শতাধিক শহীদ মিনার

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কুড়িগ্রামের পাড়া-মহল্লায় দুই শতাধিক শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে শিশু-কিশোররা। কলাগাছ, বাঁশ, কাদামাটি, কাঠ ও ইটের সমন্বয়ে এসব শহীদ মিনার বানিয়ে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানালো তারা। 

বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জেলা শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ঘুরে দেখো গেছে, অলিগলিতে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে তাতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাচ্ছে শিশু-কিশোররা। কেউ কলাগাছ কেটে খোলা মাঠে, আবার কেউ বাড়ির আঙিনায় বাঁশ-মাটি দিয়ে, কেউ আবার সড়কের পাশে কাঠ ও কাগজ মুড়িয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়েছে। সেগুলোতে ইট, বালু ও কাঠ দিয়ে তৈরি করেছে শহীদ বেদি। সৌন্দর্য বাড়াতে রশি টানিয়ে তাতে লাগানো হয় রঙিন কাগজ। বাড়ির আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন ফুল। নিজেদের বানানো এসব শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে সকাল থেকে জড়ো হয় শিশু-কিশোররা।

কলাগাছ, বাঁশ, কাদামাটি, কাঠ ও ইটের সমন্বয়ে এসব শহীদ মিনার বানিয়ে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদরের পুরাতন রেলস্টেশন পাড়া, হরিকেশ মধ্যপাড়া, আলমপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় শিশু-কিশোরদের হাতে তৈরি হয়েছে দুই শতাধিক শহীদ মিনার। বাঁশ, ইট, কাঠ, কলাগাছ, ককশিট ও সুতা দিয়ে এসব শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে তারা। ফুল দিয়ে সাজিয়েছে মিনারের বেদি।

পুরাতন রেলস্টেশন পাড়ায় কাঠ দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী সুস্মিতা দত্ত ও সোহাগ। নিজেদের তৈরি শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর তারা জানায়, গত বছরও আমরা এভাবে শহীদ মিনার বানিয়েছিলাম। ফুল দিয়েছিলাম। এবার আমাদের পাড়ায় অন্তত ৩০টি শহীদ মিনার বানানো হয়েছে। কয়েক পরিবারের শিশুরা মিলে একেকটি শহীদ মিনার বানিয়েছে। একদল শিশুকে দেখে আরেক দল আগ্রহী হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জেনে আমরা এটি করেছি। এতে আমাদের অভিভাবকরা উৎসাহ দিয়েছেন।

হরিকেশ মধ্যপাড়ার বিমল সেন বলেন, ‌‘একসময় ভাষা দিবস ঘিরে পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোররা বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করে শ্রদ্ধা জানাতো। এখন এই চর্চা অনেকাংশে কমে গেছে। ভাষাশহীদদের অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাই।’

পাড়া-মহল্লা ঘুরে দেখো গেছে, অলিগলিতে অস্থায়ী শহীদ মিনার

পাড়া-মহল্লায় শহীদ মিনার নির্মাণে শিশু-কিশোরদের উজ্জীবিত করতে কাজ করছে কুড়িগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রচ্ছদ। সংগঠনটি অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য শিশু-কিশোরদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে হারিয়ে যেতে বসা এই সংস্কৃতি আবারও প্রাণ পেয়েছে বলে মনে করছেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেন, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ধারক শহীদ মিনার। দুই দশক আগেও পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোররা শহীদ মিনার নির্মাণ করতো। কিন্তু এই চর্চা অনেকটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগামী প্রজন্মের কাছে একুশের চেতনা ছড়িয়ে দিতে এটিকে জাগ্রত রাখার উদ্যোগ নিয়েছে প্রচ্ছদ।

সংগঠনের নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছর জেলা সদরের বিভিন্ন অলিগলিতে ১৩৮টি অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণকারীকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ বছরও জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক শহীদ মিনার তৈরি করেছে শিশু-কিশোররা। সেখান থেকে বাছাই করে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণকারীকে পুরস্কার দেওয়া হবে।

প্রচ্ছদ কুড়িগ্রামের সভাপতি শ্যামল ভৌমিক বলেন, ‘একুশের চেতনা শিশু-কিশোরদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে জেলা সদরের পাড়া-মহল্লায় চতুর্থবারের মতো শহীদ মিনার নির্মাণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি আমরা। এই আয়োজনে সাড়াও মিলেছে। এবার জেলা সদরের পাড়া-মহল্লায় দুই শতাধিক অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। শিশু-কিশোররা এই আয়োজনে আনন্দের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও ভাষাশহীদদের অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে এই প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।’

শহীদ মিনার বানিয়ে তাতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাচ্ছে শিশু-কিশোররা

এদিকে, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জেলা শহরের বিজয় স্তম্ভ প্রাঙ্গণে চার দিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। বুধবার বেলা ১১টায় মেলার উদ্বোধন করেন কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. হামিদুল হক খন্দকার। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার ও পৌর মেয়র কাজিউল ইসলাম।