‘শেখ সাবের ডাকে যুদ্ধত গেছলাম, কিতা পাইলাম?’

মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী

‘শেখ সাবের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ডাকে যুদ্ধত (যুদ্ধে) গেছলাম। দেশের লাগি যুদ্ধ করছি জান বাজি রাখি। দেশ স্বাধীন অইল, স্বাধীন দেশে মাথা গোজার একটু ঠাঁই অইলা না। কিতা পাইলাম? ভাতা ছাড়া আর কোনতাই (কিছুই) পাইলাম না!’

এভাবে আক্ষেপ নিয়েই কথাগুলো বলেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী। ৯০ বছরের এই মুক্তিযোদ্ধা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। হাঁপানিসহ নানা জটিল রোগ শরীরে বাসা বেধেছে। প্রায় ১৬ বছর ধরে সিলেট নগরীর তেররতন এলাকার একটি কলোনিতে আশ্রিতের মতো বসবাস করছেন। বাঁচার তাগিদে ২০১২ সাল থেকে ভিক্ষা শুরু করেন। ভিক্ষা আর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা থেকে পাওয়া টাকা জমিয়ে বিয়ে দেন দুই মেয়েকে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভিক্ষা করেই চালিয়েছেন পরিবার। অসুস্থতার কারণে প্রায় দেড় বছর ধরেই বাসায় পড়ে আছেন।

কলোনির বাসায় মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তার যখন ২২ বছর তখন যুদ্ধ শুরু হয়। সেই স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘দেশে যুদ্ধ যখন ছলের (চলছে), তখন শেখ সাব ডাক দিলা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার লাগি। তার ডাক হুনিয়া গ্রামের আরও কয়েকজন বড় ভাইর লগে যুদ্ধে যাই। যুদ্ধ করিয়া দেশ স্বাধীন করলাম। কিন্তু ভাতা ছাড়া আর কিতা পাইলাম? স্বাধীন দেশে এখনও তো আমরা মুক্তিযোদ্ধারাই বড় দুঃখী, আমরার দুঃখ কষ্ট গেল না।’

স্ত্রী নূরজাহান বেগমের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী

এটুকু বলে খানিকটা থামলেন রহমত আলী। দ্যুতি কমে যাওয়া চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যায়। আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমরারে (মুক্তিযোদ্ধাদের) যে সম্মান দেওয়ার কথা তা আমরা পাই না। এখন যদি সরকার থাকি আমারে একটু জায়গা দেওয়া অয়, তাইলে যুদ্ধে গিয়া আমার জীবন সার্থক বলে মনে করমু। মরলেও শান্তি পাইমু।’

মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লহরাজপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কুলাউড়া থেকে এসে ৯নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাকে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দিয়ে প্রস্তুত করেন ক্যাপ্টেন সি আর দত্ত। যুদ্ধ চলাকালীন একদিন রাতের অপারেশনে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। এখনও বুলেটের চিহ্ন তার বা পায়ে। সেই থেকে খুঁড়িয়ে চলতে হয় রহমত আলীকে।

বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাহিল রহমত আলীর দিন কাটে এখন বাসায় বসে। মাথার ওপর সেবার হাত শুধু স্ত্রী নূরজাহান বেগমের। এভাবেই কাটছে তার দিনরাত্রি।

syl pic 4

নূরজাহান বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েকবছর আগে তিনি ভিক্ষা করেই সংসার চালাতেন। ভিক্ষার টাকা আর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা জমিয়ে মেয়েদেরকে বিয়েও দিয়েছেন। ২ মেয়ে আর ৪ ছেলের পরিবার ছিল। ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা সংসার করোছ। মুক্তিযোদ্ধার ভাতায় চলে সংসার। শুধু চিকিৎসা আর ওষুধের খরচ বাবদ কোনও কোনও মাসে ভাতার ‍পুরো টাকাই চলে যায়। এসময় হাত পেতে স্থানীয়দের সহায়তা নিতে হয়।’

তিনিও আক্ষেপ নিয়েই বলেন, ‘দেশপাগল মানুষ জান বাজি রাখি যুদ্ধ করছে। এখন তার জানটায় জং ধরেছে (অসুস্থতা)। দেশের মাটিত নিজের একটু জমি পাইলে মানুষটা বড় শান্তি পাইতো।’

/এসটি/